কুমিল্লার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন
প্রকাশকালঃ
০৩ এপ্রিল ২০২৪ ১১:৫৭ পূর্বাহ্ণ ৬১২ বার পঠিত
বর্তমানে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ঐতিহ্যমন্ডিত ও বিখ্যাত একটি জেলা হচ্ছে কুমিল্লা। ১৭৯০ সালে সর্বপ্রথম কুমিল্লার জেলা প্রতিষ্ঠিত হলেও তখনও এই জেলার নাম কুমিল্লা ছিল না। ত্রিপুরা নামে এই জেলাটি তৎকালীন সময়ে পরিচিত লাভ করে। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে এই ত্রিপুরা জেলার নামকরণ করা হয় কুমিল্লা। তো চলুন জেনে আসি, কুমিল্লা জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত?
কুমিল্লা জেলার কিছু বিখ্যাত স্থান
শালবন বিহার ও প্রত্নতাত্বিক জাদুঘর বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডমি (বার্ড) ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের সমাধিক্ষেত্র) বেীদ্ধবিহার গোমতি নদী নবাব ফয়জুন্নেছার পৈতিক বাড়ি বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন শ্রী শ্রী রামঠাকুরের আশ্রম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম স্ত্রী বেগম নার্গিসের বাড়ি ধর্মসাগর ৩,০৮৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট কুমিল্লা জেলা মোট ১৭ টি উপজেলায় বিভক্ত। উপজেলা সংখ্যা বিবেচনায় কুমিল্লাকে “এ ক্যাটাগরি ভুক্ত জেলার” তালিকায় রাখা হয়েছে।
কুমিল্লা জেলার পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অবস্থান এবং উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে বিখ্যাত মেঘনা নদী। রসমালাইয়ের জন্য যেমন সারা বাংলাদেশে কুমিল্লা জেলা বিখ্যাত, ঠিক তেমনি এই জেলার মৃৎশিল্প, তাঁত শিল্প, কুটির শিল্প বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ। কুমিল্লা নামটি শুনলে প্রথমেই যে জিনিসটির কথা সবার আগে মনে পড়ে সেটি হলো কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই। আনুমানিক উনিশ শতকের দিকে খনিন্দ্র সেন ও মণিন্দ্র সেন নামের দুই ভাইয়ের মাধ্যমে এই রসমালাইয়ের স্বাদের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কুমিল্লা কিসের জন্য বিখ্যাত?
প্রশ্নটির উত্তর হচ্ছে বিভিন্ন মিষ্টান্নের জন্য কুমিল্লা জেলা বিখ্যাত। কুমিল্লার মাতৃভান্ডার রসমালাইয়ের জন্য বিখ্যাত। যদিও বর্তমানে মাতৃভান্ডার নাম ধারণ করে বহু জায়গাতেই রসমালাই বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু আসল রসমালাইয়ের খাঁটি গুণ ও স্বাদ ঠিকই প্রকৃত কুমিল্লাবাসীরা পরখ করে চিনে নিতে পারেন। কুমিল্লার তাঁত শিল্প বিখ্যাত ছিল মুঘল আমল থেকেই। সে সময়ে কুমিল্লার ময়নামতি, চান্দিনা, দেবিদ্বার, গৌরীপুর, নবীনগরে সমস্ত এলাকার মানুষদের প্রধান পেশা গুলোর মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিল এই তাঁত বুনন পেশা।
হিন্দু গোষ্ঠী কারিগরের সংখ্যা প্রথম দিকে বেশি থাকলেও তাঁতের কাপড়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ ও চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকলে মুসলিম গোষ্ঠীর মানুষেরাও এই পেশার সাথে যুক্ত হতে থাকে। সভ্যতা যাঁতাকলে এই প্রাচীন ঐতিহ্য আজ অনেকটাই বিলুপ্তির পথে, তবুও চান্দিনা ও দেবিদ্বারের মত আরো অঞ্চলের কিছু তাঁতিরা এখনো তাদের দক্ষ হাতের তাঁত বুনন কৌশলে অতীতের চিহ্ন কিছুটা হলেও বাঁচিয়ে রেখেছে। কুমিল্লা জেলার আর একটি ঐতিহ্যবাহী দিক হলো কুটির শিল্প। এই শিল্পকে অনেকে হস্তশিল্প অথবা গ্রামীণ শিল্প বলা হয়। কেননা পল্লী অঞ্চলের সাধারণ মানুষেরা প্রকৃতি থেকে সৌন্দর্য্যকে ধারণ করে সেগুলো কুটির শিল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলে নিজেদের জীবিকার অর্থ যোগান করে থাকে। এই কুমিল্লাতেই বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) প্রতিষ্ঠানটি অবস্থিত।
কুটির শিল্প যেমন বাংলাদেশের মানুষের জীবিকা নির্বাহে সাহায্য করে তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারেও বাংলার মানুষের হস্ত শিল্পের অবদান উল্লেখযোগ্যভাবে প্রশংসনীয়। কুটির শিল্পের সাথে সাথে মৃৎশিল্প কুমিল্লার ভূমিকাও রয়েছে। বিশেষ করে কুমিল্লার বিজয়পুর অঞ্চলে এই সকল মৃৎশিল্প কারিগরদের খুঁজে পাওয়া যাবে যারা মাটি দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্রকে এক অনন্য রূপ ফুটিয়ে তুলে। কুমিল্লার মাটিতে রয়েছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানসমূহ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ইতিহাসমন্ডিত এই স্থানগুলো বরাবরই পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। তার মধ্যে একটি হলো শালবন বৌদ্ধ বিহার। কুমিল্লার জেলার ময়নামতিতে কোটবাড়ি বোর্ডের কাছেই এই স্থাপনাটি অবস্থিত।
কুমিল্লা জেলার আরেকটি আকর্ষণ হলো ২১ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট লালমাই পাহাড়। প্রধান শহর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দুরে এই সুনিবিড়, ছায়াঘেরা, সবুজের চাদরে আবৃত এই পাহাড়টির সৌন্দর্য যেকোনো ভ্রমণ প্রেমিকের মনে দাগ কাটবে নিঃসন্দেহে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তীর্থের স্থান হিসেবে পরিচিত লালমাই পাহাড় চূড়ার চন্ডীমুড়াও কুমিল্লা জেলার একটি দর্শনীয় স্থান। এছাড়া কুমিল্লা জেলার রূপবান মুড়া আরো একটি ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে যার নির্মাণকাজ অষ্টম শতাব্দীরও আগে।
এছাড়াও কুমিল্লায় রয়েছে আনন্দ বিহার, ইটাখোলা মুড়া, ধর্মসাগর, ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি, ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্ক ইত্যাদি এর মত পর্যটন কেন্দ্র। নদীগুলোর মধ্যে কুমিল্লা গোমতী নদী বেশ উল্লেখযোগ্য ও ঐতিহাসিক একটি নদী। পূর্বে গোমতী নদীর ভয়ঙ্কর রূপ কুমিল্লাবাসীদের দুঃখের ও আতঙ্কের কারণ থাকলেও বর্তমানে এই নদীর ব্যবস্থা উন্নয়ন করা হলে তা কৃষিকাজে বেশ সফলতা প্রদান করেছে। ভবিষ্যতে এই গোমতী নদীকে কেন্দ্র করে আরো বৃহৎ পরিকল্পনা রয়েছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বৃহৎ এই কুমিল্লা জেলাকে মেঘনা বিভাগ করার প্রস্তাবনা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।