পাগলা মসজিদ, কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক এক প্রতীক। দেশ-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করা এই মসজিদটি প্রতি তিন মাস অন্তর দানবাক্স খোলার মাধ্যমে সংবাদের শিরোনাম হয়। মসজিদের দানবাক্স থেকে পাওয়া যায় বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার, বৈদেশিক মুদ্রা এবং অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী। শুধু মুসলিম নয়, বিভিন্ন ধর্মের মানুষও এখানে দান করেন। এমনকি বিদেশ থেকেও আসে দানের অর্থ।
কিশোরগঞ্জ শহরের হারুয়া এলাকায় অবস্থিত পাগলা মসজিদটির ইতিহাস নিয়ে জনশ্রুতির অভাব নেই। প্রায় ১৫০ বছর আগে প্রমত্তা নরসুন্দা নদীতে ধ্যানরত এক ভাসমান দরবেশের কারণে মসজিদের প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। তার অলৌকিক ঘটনাবলীতে মুগ্ধ হয়ে স্থানীয় লোকজন তার স্মৃতিতে মসজিদটি নির্মাণ করেন। অন্য একটি প্রচলিত কাহিনী অনুসারে, নরসুন্দার তীরে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে "পাগলা বিবি" নামে পরিচিত এক নারী এই মসজিদ নির্মাণ করেন।
পাগলা মসজিদের ওয়াকফ সম্পত্তি এখন প্রায় ৩.৮৮ একর জমি জুড়ে বিস্তৃত। মসজিদের অর্থায়নে পরিচালিত হয় এতিমখানা ও মাদ্রাসা, যেখানে শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া, পোশাক ও শিক্ষার সব খরচ বহন করা হয়।
১৯৭৯ সাল থেকে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকা এই মসজিদের কার্যক্রম তদারকি করেন জেলা প্রশাসক, যিনি পদাধিকার বলে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি। বর্তমানে কমিটিতে ৩১ জন সদস্য রয়েছেন। দানের অর্থ দিয়ে এলাকার অন্যান্য মসজিদের সংস্কার, দরিদ্র মানুষের সাহায্য, চিকিৎসা খরচ এবং শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করা হয়।
পাগলা মসজিদের সব দানের টাকা জমা রাখা হয় কিশোরগঞ্জের রূপালী ব্যাংকে। যদিও এই অ্যাকাউন্টে জমাকৃত টাকার পরিমাণ গোপন রাখা হয়, ধারণা করা হয় এতে শত কোটি টাকারও বেশি সঞ্চিত রয়েছে।
মসজিদের আয়ের ওপর ওয়াকফ প্রশাসনের ৫ শতাংশ চাঁদা কেটে নেওয়া হয় এবং বাকি অর্থ থেকে মসজিদ ও মাদ্রাসার পরিচালন ব্যয় মেটানো হয়। আনুষঙ্গিক ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল এবং আনসারের বেতন।
দানবাক্স থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে অসুস্থ, দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তা করা হয়। ২০২১ অর্থবছরে ১২৪ জনের চিকিৎসা খাতে ১৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকা এবং করোনাকালে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়।
গত শনিবার, ৩০ নভেম্বর, তিন মাস ১৪ দিন পর পাগলা মসজিদের ১১টি দানবাক্স খোলা হয়। এবার পাওয়া গেছে ২৯ বস্তা টাকা। জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান এবং পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরীর উপস্থিতিতে টাকা গণনার কাজ শুরু হয়, যেখানে মাদ্রাসা ও এতিমখানার শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ প্রায় ৩৫০ জন অংশ নেন।
এর আগে ১৭ আগস্ট খোলা দানবাক্সে ৭ কোটি ২২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬ টাকা, বৈদেশিক মুদ্রা এবং স্বর্ণালংকার পাওয়া গিয়েছিল। দিনে দিনে দানের প্রবণতা বাড়ায় এখন প্রতি তিন মাস অন্তর দানবাক্স খোলা হয়।
পাগলা মসজিদের দানের অর্থ ব্যবহার করে এলাকার উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং মানবিক সহায়তার কাজ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। মসজিদ কমিটির মতে, দানের অর্থ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা বজায় রাখার পাশাপাশি স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে এর কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করা হবে।
পাগলা মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়; এটি সমাজসেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।