প্রকাশকালঃ
০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:৪৮ অপরাহ্ণ ২৬৫ বার পঠিত
অগণিত মানুষের ভালোবাসা নিয়েই হীরকখণ্ডের মতো দ্যুতিময় সংগীতজীবন যাপন করেছেন আশা ভোসলে। আগামীকাল ৮ সেপ্টেম্বর ৯০ পূর্ণ করবেন উপমহাদেশের এই কিংবদন্তিতুল্য কণ্ঠশিল্পী।
গল্পটি আশা ভোসলে নিজেই শুনিয়েছিলেন এক সাক্ষাৎকারে। এক বন্ধু তাঁকে নাকি বলেছিলেন, আশার জন্মের ঠিক আগে স্রষ্টা বলেছিলেন, ‘তোমাকে একটি সুসংবাদ এবং একটি দুঃসংবাদ দিয়ে দুনিয়ায় পাঠাব। সুসংবাদটি হলো তুমি বিখ্যাত একটি সংগীত পরিবারে জন্মাবে এবং গানে গানে বহুদূর যাবে। আর দুঃসংবাদটি হলো তোমার বড় বোনের জন্য ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ প্লেব্যাক গায়িকার স্বীকৃতি তোলা থাকবে, তোমার সেখানে জায়গা হবে না!’
গল্প হলেও কথাটা নেহাত ভুল নয়। বছরের পর বছর ভারতীয় সিনেমা–দুনিয়ায় নারী কণ্ঠের তালিকায় সবার ওপর ছিল দুটি নাম—লতা ও আশা। এত গান, এত এত সুর ও সুরকার, এত দীর্ঘ বছরে শ্রোতা পাল্টে গেছে, বদলে গেছে প্রজন্ম। কিন্তু তাঁদের জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি। লতা বিদায় নিয়েছেন। ৯০ পেরোনোর অপেক্ষায় থাকা আশা মুম্বাই থেকে দুবাই গেছেন। ১ সেপ্টেম্বর ইনস্টাগ্রামে একটি ভিডিও দিয়েছেন ‘তরুণ’ এই শিল্পী। এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে গাড়িতে করা ভিডিওতে কেডস পায়ে, শাড়িতে সমুজ্জ্বল আশা মুঠোফোনে গেম খেলছেন। ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘যাচ্ছি। ৮ সেপ্টেম্বর দেখা হবে দুবাইতে। আমার জন্মদিনে।’ একই দিন আরেকটি ভিডিও দিয়ে লিখেছেন, ‘আমার সাম্প্রতিক পেশা অনলাইন ভিডিও গেমিং!’
মুঙ্গেশকর থেকে ভোসলে
১৯৩৩ সালে তাঁর জাগতিক ভ্রমণ শুরু। দীননাথ মঙ্গেশকরের কন্যা গান গাইবেন, এটা যেন সরল অঙ্ক। বাবার রাস্তায় পথিক হলেন জ্যেষ্ঠ কন্যা, লতা।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে পিতৃহারা হয়ে পরিবারের অর্থনৈতিক দুরবস্থা সামলে নিতে লতা কঠিন সংগ্রাম করে তাঁর পথ তৈরি করে নিয়েছেন, আমৃত্যু সে পথে অবিচল ছিলেন।
লতার মতো বোন আশার রক্তেও যেমন সংগীত ছিল, তেমনি ছিল স্রষ্টাপ্রদত্ত কণ্ঠ এবং দ্রুত যেকোনো কিছু আয়ত্তে আনার দক্ষতা। তবে বোনের মতো ঠিক মনঃসংযোগের ধৈর্য ততটা ছিল না। বরং কৈশোর পেরোনোর আগেই সংসার করা, ঘুরে বেড়ানো—এসব খেয়ালেই ছিলেন মেতে। ১৩ বছর বয়সে ভুলটা করেই ফেললেন। গণপত ভোসলের হাত ধরে সংসার সাজানোর সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, তা আজ নিজেই মানেন আশা। তবে গণপত ভোসলে নিজের অজান্তে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করেছিলেন। স্ত্রীকে রান্নাঘরে আটকে ফেলার বদলে তাঁকে গান গেয়ে রোজগারের পথে ঠেলে দিয়েছেন। আসলে আশার অদৃষ্টে যে গন্তব্য ছিল লেখা, সেখানেই তিনি পৌঁছালেন, তবে সরল–সহজ পথে নয়।
অনেক ঘুর পথে, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে। স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসারের সুখের অন্বেষণ করতে গিয়ে আশাকে পড়তে হলো ঘর-বাইরের টানাপোড়েনে। তাঁর প্রতিদিনের রুটিনটা ছিল এমন, ভোরে ঘুম থেকে উঠে রান্নাবান্না, স্বামী-শাশুড়ি সেবা, সন্তান পালনের দায় মিটিয়ে লোকাল ট্রেনে চড়ে স্টুডিও পাড়ায় ঘুরে ঘুরে সংগীত পরিচালকদের কাছে দেনদরবার। শুধু টিকে থাকার সংগ্রামের দিনগুলোতে কি তিনি ভেবেছিলেন, যুগের পর যুগ তিনি ভারতীয় সংগীত তথা চলচ্চিত্রজগতের সিংহাসনে থাকবেন?
একলা চলো রে
স্বপ্নভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। স্বামীর সঙ্গে মতবিভেদ ক্রমে এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে উঠল। একদিন যাঁর হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলেন, অচিরে তাঁকেই ছাড়তে হলো। বাড়ির অমতে বিয়ে করার কারণে সেখানে ফেরার পথও বন্ধ। জীবন ও জীবিকার তাগিদে একাই শুরু করলেন নতুন সংগ্রাম। এ লড়াইয়ে অস্ত্র বলতে ছিল শুধু কণ্ঠস্বর, অদম্য জেদ এবং চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সাহস। চলচ্চিত্রের গানে পঞ্চাশের দশক লতা মঙ্গেশকরময়। সব সংগীত পরিচালকেরই প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় পছন্দ ছিলেন লতা। সেখানে আশার সুযোগ পাওয়াটা সহজ ছিল না। আশা সেসব গানই গাওয়ার সুযোগ পেতেন, যেগুলো লতা গাইতে রাজি হতেন না। ছবিতে এসব গানে কণ্ঠ মেলাতেন শিশুশিল্পী অথবা নাইট ক্লাবের নর্তকী। গীতা দত্তর বদলি হিসেবেও কিছু গান গেয়েছেন আশা।
আশার শুরুটা ছিল কোনো বাছবিচার না করে নিজের পরিচিতি বাড়ানো আর গাওয়ার যোগ্যতা তুলে ধরা। টিকে থাকার এই সংগ্রামের পাশাপাশি নিজেকেও সমৃদ্ধ করেছেন। সে সময় বিখ্যাত পপ বা রক শিল্পীদের গায়কি থেকে নানা কলাকৌশল নিজের গলায় তুলে নিয়ে আলাদা নিজস্ব এক গায়নরীতিতে নিজেকে তুলে ধরেন তিনি। এতে করে একটি ধারার গানে অন্তত আশার চাহিদা তৈরি হলো।
একসময় সংগীতকার ও পি নাইয়ারের সুনজরে পড়লেন আশা। অল্প দিনেই গীতা দত্ত ও শামসাদ বেগমকে পেছনে ফেলে নাইয়ারের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠলেন তিনি। বৈজয়ন্তীমালার মতো নামী নায়িকার জন্য প্লেব্যাক করার সুযোগ পেলেন।
এদিকে শচীন দেববর্মনের সঙ্গে লতার দূরত্ব ছিল বেশ কিছুদিন। সেই ‘সুযোগ’ কাজে লাগালেন আশা। অন্যদিকে রয়্যালটি-সংক্রান্ত ঝামেলায় ‘লতা-রফি ডুয়েট’ বন্ধ হলো। লতার স্থানে এলেন আশা। শঙ্কর-জয়কিষণ জুটিরও দ্বিতীয় পছন্দের গায়িকা হয়ে গেলেন আশা। চটুল-চঞ্চল ধরনের গান, ক্যাবারে, কাওয়ালি চালের গানে প্রায় সব সংগীত পরিচালকই নির্ভর হয়ে উঠলেন আশা ভোসলের প্রতি। এভাবে একটু একটু করে বোনের সাম্রাজ্যে ঢুকে পড়লেন আশা।
কান্ডারি আর ডি বর্মন
তিয়াত্তর সালের দিকে আশার সঙ্গে ও পি নাইয়ারের সঙ্গেও মতবিরোধ হলো। তবে এর মধ্যে আশা পেয়ে গেছেন তাঁর পরবর্তী উত্থানের সিঁড়ি—রাহুল দেববর্মনকে। রাহুল একে একে সুপারহিট গান তুলে দিয়েছেন আশার কণ্ঠে। আশা সেই গানের যথাযথ মর্যাদা দিয়েছেন। গানের সূত্রেই মন দেওয়া–নেওয়া হয়েছিল আর ডি বর্মন ও আশার। শোনা যায়, দুজন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে গান শুনতেন। সংগীত পরিচালক বা প্রযোজক, এমনকি রেখার মতো জনপ্রিয় নায়িকাদেরও অনেকেই আশার কণ্ঠের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন। এমনও শোনা যায়, স্বয়ং লতাও সস্নেহ বলেছেন, ‘কোনো কোনো গান আশা এমনভাবে গায় যে মনে হয়, ওর মতো করে যদি ওই গানগুলো গাইতে পারতাম!’ প্রাপ্তির শিখরে বসে থাকা প্লেব্যাক–সম্রাজ্ঞী লতার কাছেও এভাবেই ঈর্ষণীয় হয়ে উঠেছেন আশা। এভাবে বলিউড সাম্রাজ্যে নিজেকে শক্তপোক্ত জায়গায় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আশা বিস্তৃত করেছেন তাঁর বিচরণের পরিধি। চটুল থেকে সিরিয়াস গানে যেমন তাঁর অনায়াস বিচরণ, তেমনি মঞ্চের জমজমাটি পরিবেশনাতেও তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে।
বিচিত্র তাঁর ভান্ডার
এক জীবনে কত গান, কত বিচিত্র সুরেই না গাইলেন আশা! যে কণ্ঠে তিনি গেয়েছেন ‘ছোটাসা বালমা’, ‘মেরা মন দর্পণ’–এর মতো রাগপ্রধান গান, তেমনি সেই কণ্ঠে গেয়েছেন ‘ভোমরা বড়া নাদান’, ‘ঝুমকা গিরা রে’, ‘পিয়া তু অব তো আজা’, ‘দম মারো দম’, ‘চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে’-এর মতো আসর জমানো গান। আজও এসব গানে কনসার্ট তুঙ্গে ওঠে। এখনো এসব গানের রিমিক্স হয়। শুধু কি হিন্দি সিনেমার গান? সেই সময়ের সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় শাসিত ভারতীয় বাংলা সিনেমায় ঢুকতে খুব বেশি সময় লাগেনি আশার। চলচ্চিত্রের গানের পাশাপাশি নানা ধরনের নিরীক্ষামূলক গানেও পারঙ্গমতার স্বাক্ষর রেখেছেন আশা ভোসলে। গুলাম আলীর সুরে ‘মিরাজ-ইয়ে-গজল’ সংকলন, হরিহরণের সুরে গজল সংকলন ‘অবসর-ইয়ে-গজল’, জয়দেবের সুরে ‘সুরাঞ্জলি’ এর উদাহরণ। কোনো কোনো বিরূপ সমালোচনাকে ছাপিয়ে আশার গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবামও দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে শ্রোতৃমহলে। আবার নজরুলের গান কণ্ঠে নিয়েও মুগ্ধ করেছেন সংগীতপ্রিয় শ্রোতাদের।
নেশা রান্না আর পড়া
ছোটবেলায় ঘরে বিদ্যুতের সংযোগ ছিল না। ছোট্ট আশা তাই কোনো কোনো দিন খোলা দরজা দিয়ে আসা সড়কবাতির আলোয় বই পড়তে পড়তে কাটিয়ে দিতেন সারা রাত। পড়ার এমনই নেশা ছিল তখন। নেশাটা কিন্তু যায়নি। মারাঠি সাহিত্য, মারাঠিতে অনুবাদ করা যেকোনো ভাষার উপন্যাস বা হিন্দি গল্প—হাতের কাছে পেলে কিছুই এখনো ছাড়েন না। নিয়মিত লেখালেখিও করেন ভারতীয় বিভিন্ন পত্রিকায়।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক সাক্ষাৎকারে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ‘গায়িকা না হলে কী হতেন?’ আশার ঝটপট জবাব, ‘পেশাদার রাঁধুনি হতাম। বেছে বেছে চারটা বাসায় রান্না করে প্রচুর টাকা কামাতাম।’ রান্না করতে খুব ভালোবাসেন তিনি। রাঁধেনও চমৎকার। মুম্বাইয়ের অনেক নায়ক-নায়িকাই তাঁদের প্রিয় আশাজিকে পেলে মাংস আর বিরিয়ানি খাওয়ানোর জন্য চেপে ধরেন। কাপুর পরিবারে তো আশা ভোসলের রান্না করা মাছ, পায়া কারি আর ডাল ভীষণ জনপ্রিয়। ‘আশাজ’ নামে তাঁর ১০টি রেস্তোরাঁ আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।
কেটে যায় দিন
এখনো প্রতিদিন রেওয়াজ করেন। সে কথা নিজেই জানিয়েছেন। তাঁর রেওয়াজের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। সকাল সাতটা থেকে নয়টা, কখনো আবার ভোর পাঁচটা বা দুপুরবেলায়ও রেওয়াজ করেন তিনি। ঘুম না এলে মধ্যরাতেও তানপুরা নিয়ে রেওয়াজ বসে যান। রেওয়াজে বসার আগে নিজেই এক কাপ চা বানিয়ে নেন। গান, রেওয়াজ, সংসার, রান্না, বই পড়া—এতটা ‘কমপ্লিট উইমেন’ হওয়া কী করে সম্ভব? এক সাক্ষাৎকারে আশা ভোসলে বলেছিলেন, ‘আমি চাই মানুষ আমাকে মনে রাখুক সেই নারী হিসেবে, যে সৎ মন নিয়ে আপ্রাণ কাজ করেছে। যে কাজ থেকে কখনো পালিয়ে যায়নি। যে স্টেজ থেকে নেমে আবার সংসারটা চালিয়েছে, নিজে রান্না করেছে।’ এই বয়সেও যে এত উদ্যম, শরীরজনিত সমস্যা নেই? আশার জবাবটা ছিল পরিষ্কার, ‘আমার রক্তচাপ পুরোপুরি ঠিক আছে। সুগার নেই। কোলেস্টেরল নেই। তবে হিমোগ্লোবিনটা একটু কম আছে। মাঝেমধ্যে সেটা বেশ সমস্যা করে। পাত্তা দিই না। সেটা নিয়েই লড়ছি।’
এভাবে ভারতীয় তথা উপমহাদেশের সংগীত ভুবনে দাপটের সঙ্গে ছুটে চলছেন তা–ও ৮০ বছর হয়ে যাবে। বিখ্যাত গীতিকার গুলজার একবার দুই বোনের তুলনা প্রসঙ্গে আশাকে বলেছিলেন, ‘লতা ও তুমি দুজনই চাঁদে গেছ। কিন্তু লতা প্রথম চাঁদের মাটিতে পা রেখেছে বলে চিরকালই ১ নম্বর থেকে যাবে, তুমি থাকবে তার পরে।’ এতে হয়তো আফসোস আছে কিংবা নেই। সুখের পাল্লা ভারী হতে হতে দুঃখেরা বুকের গভীরে মুক্তো হয়ে বয়ে গেছে। স্বামী, সন্তান হারানো আশার আফসোস, ‘আমার সামনে সবাই এক এক করে চলে গেছেন। আমি একা রয়ে গেছি।’ তবে পুরোপুরি একাকীও নন আশা, বিশ্বজুড়ে অগণিত ভক্তের ভালোবাসা জড়িয়ে আছে তাঁকে।