সংকট ও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় রেখে আগামী বাজেট প্রণয়নের দাবি
প্রকাশকালঃ
১৭ মে ২০২৩ ০২:৩৫ অপরাহ্ণ ১৪১ বার পঠিত
দেশে জ্বালানি–সংকটের কারণে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। রিজার্ভ কমে যাওয়া ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে ঋণপত্র খোলা ও পণ্য আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া বর্তমানে মূল্যস্ফীতিও বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই এসব সমস্যা বিবেচনায় নিয়েই আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও অর্থনীতিবিদেরা।
গতকাল সোমবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) আয়োজিত বাজেট প্রত্যাশা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বক্তারা এসব পরামর্শ দেন।
এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন সরকারের তিন মন্ত্রী। তাঁরা হলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মাজিদ মাহমুদ হুমায়ূন ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও সরকারের কয়েকটি দপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বর্তমানে যে পরিস্থিতিতে নতুন বাজেট করা হচ্ছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা বাজেটে দেখতে চাই। দেশে মূল্যস্ফীতি এখন অন্যতম সমস্যা, রপ্তানি ও আমদানি কমছে, ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ কমছে, এমন পরিস্থিতিতে সরকার এসব বিষয়ে কী ভাবছে, তার একটা ব্যাখ্যা বাজেটে দেখতে চাই।’
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, বাজেটের কিছু কাঠামোগত সমস্যাও আছে। বাজেটে যে পরিমাণে ব্যয় ধরা হয়, তার চেয়ে রাজস্ব আদায় অনেক কম। এটা কীভাবে সমাধান করা হবে, তারও দিকনির্দেশনা বাজেটে থাকা প্রয়োজন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের বাজেটের আকার দৃশ্যত অনেক বড় দেখালেও জিডিপির অনুপাতে তা এখনো অনেক কম। সেই হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও এটি অনেক কম। বাজেটে যে পরিমাণ ঘাটতি আছে, তা মেটাতে আরও বেশি অর্থের সংকুলান প্রয়োজন। এটা বাজেটের একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সে জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের পরামর্শ দেন তিনি।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়। মূল্যস্ফীতি বাগে আনা এবারের বাজেটের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। মূল্যবৃদ্ধির জন্য শুধু আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির দোহাই দিলে হবে না। মূল্যস্ফীতির বাড়ার পেছনে আর্থিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা আছে বলে মত দেন তিনি।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘এখন এক বিশেষ সময় চলছে। মূল্যস্ফীতিসহ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে, তাই এ সময়ের বাজেটও বিশেষ হওয়া উচিত।’ বিশেষ এই সময়ের আর্থিক ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, এখনো অনেক অব্যবস্থাপনা রয়ে গেছে, তবে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
শিল্পমন্ত্রী নুরুল মাজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে হলে আমাদের আমদানি প্রতিস্থাপনে জোর দিতে হবে, অর্থাৎ যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, সেসব পণ্য উৎপাদনে জোর দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। তবে তাদের সুযোগ করে দিতে হবে।
মন্ত্রী আরও বলেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বিসিকে শিল্পপ্লট প্রস্তুত করা হয়েছে, কিন্তু সেখানে শিল্প স্থাপন করতে পারে, এমন ছোট উদ্যোক্তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বড় শিল্পগোষ্ঠীর অনেকে মুড়ি-চানাচুর বিক্রি করেন। তাঁর প্রশ্ন, এই বাস্তবতায় ছোট উদ্যোক্তারা কী করবে। তিনি বলেন, ছোট উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে দেশে ভোজ্যতেল আমদানির চাহিদা অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, শর্ষের উৎপাদন বাড়াতে কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। এটা বাস্তবায়ন করা গেলে আগামী তিন বছরের মধ্যে ভোজ্যতেলের আমদানি অর্ধেকে নামিয়ে আনা যাবে।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, দেশে এমন অনেক পণ্য আছে, যেগুলো আমদানির প্রয়োজন নেই বা তার পরিমাণ কমানো সম্ভব। দেশে বর্তমানে ভালো মানের ও পর্যাপ্ত পরিমাণে গরুর দুধ উৎপাদন হচ্ছে। তারপরও গুঁড়া দুধ কেন বিদেশ থেকে আনতে হবে? তাঁর মতে, ঠিকভাবে পরিকল্পনা করলে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে এক ছটাক দুধও আনতে হবে না।
বাজেট প্রত্যাশা অনুষ্ঠান সঞ্চালনাকালে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ এখন ট্রিলিয়ন ডলার বা লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতি হতে যাচ্ছে। কিন্তু রাজস্ব বোর্ডের অনেক ঘাটতি আছে। তাদের সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন।
এর পাশাপাশি কাজের বণ্টনও ঠিকভাবে করার পরামর্শ দিয়েছেন এই ব্যবসায়ী নেতা। তিনি বলেন, যিনি নীতি নির্ধারণ করবেন, তিনি বাস্তবায়ন করবেন না, এটা দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে। কিন্তু এনবিআরের ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
অনুষ্ঠানে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে দেশে দেশে নীতি সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে অর্থের সংস্থান, উৎপাদন ও পণ্যের দাম বেড়েছে। এপ্রিল মাসে রপ্তানিতে ১৬ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল। মে মাসেও তা থাকবে। এভাবে চললে রিজার্ভের ওপর আরও চাপ তৈরি হতে পারে। এই বাস্তবতায় রপ্তানিতে বাজেট সহায়তা বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
এ ছাড়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন রাখার পরামর্শ দেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি সামির সাত্তার। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে ঋণপত্রের সীমা (মার্জিন) শিথিল করেছে। কিন্তু নিত্যপণ্যের জন্য সবাই প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে পারছে কি না, তা তদারক করা প্রয়োজন। দরকার হলে এ ধরনের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের বরাদ্দ নিশ্চিত করতে রিজার্ভে বিশেষ কোটা রাখা যেতে পারে।
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দীন ভোগ্যপণ্যের দাম মানুষের নাগালের মধ্যে রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এবারের বাজেটে সেই চেষ্টা করতে হবে। আর নতুন বাজেটে আমদানি প্রতিস্থাপক পণ্য উৎপাদনে ছাড় ও প্রণোদনা চেয়েছেন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সহসভাপতি সৈয়দ মো. তানভীর।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ আলী হাতেম বলেন, ‘প্রতিবছর বাজেট নিয়ে প্রত্যাশার কথা বলে যাই, রাজস্ব বোর্ডও (এনবিআর) শুনে যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত খুব বেশি কিছু পাই না। একজন ব্যবসায়ী জীবনে যত ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে পারেন, তার সবই আমরা এখন করছি।’
অগ্রিম আয়কর নিয়ে মোহাম্মদ আলী হাতেম বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে যে এআইটি নেওয়া হয়, তা পরবর্তীকালে ঠিকভাবে সমন্বয় করা হয় না। এই প্রবণতা ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিপন্থী। আগামী বাজেটে অগ্রিম কর হ্রাস করে আগামী পাঁচ বছরের জন্য দশমিক ২৫ শতাংশ নির্ধারণের দাবি জানান তিনি।
বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, দেশে বর্তমানে ১৫ কোটি কেজি বস্ত্র বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এসব পণ্য রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার উপযোগী করার ক্ষেত্রে শুল্ক-কর দিতে হয়। বাজেটে এই শুল্ক-কর প্রত্যাহার করা হলে তুলা আমদানি ১৫ শতাংশ কমানো সম্ভব।
এসএমই খাতে ক্যাপাসিটি বিল্ডিং বা সক্ষমতা উন্নয়নের জন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মাসুদুর রহমান।
এ ছাড়া বাজেটে করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন সামির সাত্তার। তিনি বলেন, এতে উদ্যোক্তারা কর দিতে আরও উৎসাহী হবে। আর চট্টগ্রাম চেম্বারের সহসভাপতি আবিদা মোস্তফা নারী উদ্যোক্তাদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা পাঁচ লাখ টাকা করার দাবি জানান।