চীন এ পর্যন্ত দিয়েছে ৭৫০ কোটি ডলার, গত ৪ বছরে এসেছে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার।
বাংলাদেশের ঋণের যত দায় আছে, এর ৮ শতাংশই চীনের কাছ।
বাংলাদেশ ও চীন পতাকা
বাংলাদেশ ও চীন পতাকা
বাংলাদেশ এখন চীনের কাছ থেকে ঋণ নিতে বেশি আগ্রহী। বদৌলতে দেশে চীনা ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। গত কয়েক বছর ঋণদাতা দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তালিকায় চীন শীর্ষ পাঁচে উঠে এসেছে। বাংলাদেশকে ঋণ দেয় এমন ৩২টি দেশ ও সংস্থার মধ্যে চীন চতুর্থ অবস্থানে উঠে এসেছে। চীনের ওপরে আছে জাপান, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বাংলাদেশ প্রতিবছর মোট যে ঋণ পায়, তার প্রায় ১০ শতাংশ দেয় চীন।
এদিকে বার্ষিক ঋণছাড়ে পরপর দুই বছর বিলিয়ন ডলার ক্লাবে রয়েছে চীন। অর্থাৎ দেশটি টানা দুই বছর ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বা তার চেয়ে বেশি পরিমাণে ঋণ দিয়েছে। এই বিলিয়ন ডলার ক্লাবে থাকা অন্য দেশ ও সংস্থাগুলো হচ্ছে জাপান, বিশ্বব্যাংক ও এডিবি।
২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পর থেকেই এদেশে তাদের ঋণ দেওয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকে। সর্বশেষ চার অর্থবছরে দেশটি প্রায় ৩০০ কোটি ডলার ছাড় করেছে, যা তাদের দেওয়া মোট ঋণের ৪০ শতাংশের মতো। এদিকে চীনা ঋণের গতি বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি ধীরে ধীরে পরিশোধের চাপও বাড়ছে।
চীনা ঋণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা রাখছে বলে মনে করা হয়। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও এখন চীনা ঋণের আধিপত্য চলছে। শ্রীলঙ্কাও বন্দর ও সড়কসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে ব্যাপকভাবে চীনা ঋণ নিয়েছে। সেই ঋণ শ্রীলঙ্কাকে অবশ্য বড় ধরনের চাপে ফেলে দিয়েছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, চীনের ঋণ ডলারে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এখন ডলারের বিপরীতে সব মুদ্রা দুর্বল, যা ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাপানের কাছ থেকে ঋণ নিলে ঋণ পরিশোধে অনেক বেশি সময় পাওয়া যায়। অন্যদিকে চীনা ঋণ পরিশোধের সময়সীমা অনেক কম। ফলে এটি ঋণ পরিশোধে চাপ সৃষ্টি করছে।
চীনা প্রকল্পে অবশ্য ভালো দিক রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, রাজনৈতিক শর্ত ছাড়া ঋণ মেলে। শুধু চীনের বাণিজ্য কৌশলের সঙ্গে মিললেই হলো।
চার বছরে ছাড় বেড়ে দ্বিগুণ
বাংলাদেশে বেশ দ্রুতগতিতে চীনা ঋণের হিস্যা বাড়ছে। গত চার বছরে ঋণছাড় বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, কোভিড শুরু হওয়ার বছরে, অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ৬০ কোটি ডলার ছাড় করেছিল চীন। কোভিডের কারণে পরের অর্থবছরে ঋণছাড় কমে ২৪ কোটি ডলারে নেমে যায়।
তবে গত দুই অর্থবছর ধরে ঋণের অর্থছাড়ে বিলিয়ন ডলার ক্লাবে রয়েছে চীন। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ১০০ কোটি ৪০ লাখ ডলার ছাড় করে দেশটি, যা গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) আরও বেড়ে যায়। এই অর্থবছরে চীনা ঋণছাড়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১২ কোটি ৬৮ লাখ ডলার।
এভাবে ঋণের অর্থছাড়ে চীন ক্রমে শক্তিশালী অবস্থানে চলে যাচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় ঋণের ভিত্তিতে জাপানের পরেই এখন চীনের অবস্থান।
গত অর্থবছরে শীর্ষ পাঁচ দেশ ও সংস্থার মধ্যে চীনের অবস্থান ছিল চতুর্থ। এই অর্থবছরে ১৯৩ কোটি ডলার দিয়ে শীর্ষস্থানে রয়েছে বিশ্বব্যাংক। এ ছাড়া জাপান ১৯০ কোটি ও এডিবি ১৫৬ কোটি ডলার দিয়েছে। গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে ৯২৬ কোটি ডলার দিয়েছে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশ।
এ বিষয়ে ইআরডির এশীয় শাখার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘চীনের মতো এত সস্তায় এখন ঋণ পাওয়া মুশকিল। প্রতিবছর বাংলাদেশের ১ হাজার কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ প্রয়োজন হয়। বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাপানের মতো দাতাদের কাছ থেকে বছরে ৫০০ থেকে ৫৫০ কোটি ডলার পাওয়া যায়। বাকি অর্থ আমরা কোথায় পাব? তাই বিকল্প উৎস হিসেবে চীন ও ভারতের মতো দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছি। কারণ, আমাদের উন্নয়ন থামিয়ে রাখা যাবে না।’
চার বছরেই এসেছে ৪০% ঋণ
বাংলাদেশকে ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো ঋণ দেয় চীন। এরপর দীর্ঘ কয়েক দশক চীন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আর ঋণ দেয়নি। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সফরকালে বাংলাদেশকে বড় ধরনের ঋণ সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা আসে। তখন ২৭টি প্রকল্পে প্রায় ২ হাজার কোটি বা ২০ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয় দেশটি। চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশে সেই সফরের পর থেকেই ঋণের গতি বাড়ে। একের পর এক প্রকল্পও নেওয়া শুরু হয়।
গত পাঁচ দশকে চীন সব মিলিয়ে যত ঋণ দিয়েছে, তার মধ্যে গত চার অর্থবছরেই এসেছে প্রায় ২৯৭ কোটি ডলার বা ৪০ শতাংশ। ইআরডির সর্বশেষ হিসাবে ১৯৭৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাড়ে ৭০০ কোটি ডলার ছাড় করেছে চীন। দ্রুত ঋণছাড়ের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে বাংলাদেশের শীর্ষ ঋণদাতাদের মধ্যে চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে চীন। আর বাংলাদেশের ঋণের যত দায় আছে, তার ৮ শতাংশই এখন চীনের কাছে।
চীনা ঋণে নেওয়া ২৭ প্রকল্পের মধ্যে বর্তমানে আটটির জন্য প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি ডলারের মতো চুক্তি হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রেল ও সড়কসহ চীনা ঋণে ১৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পে ঋণের পরিমাণ এক হাজার কোটি ডলারের মতো।
চীনা ঋণে যত অসুবিধা
চীনা ঋণের অসুবিধা হলো, এটি পুরোটাই সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট বা সরবরাহকারী ঋণ। এর আওতায় চীনা কর্তৃপক্ষই ঠিকাদার ঠিক করে দেয়। আবার ঋণ নিয়ে দর-কষাকষির সময়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই দাম-দর চূড়ান্ত করে থাকে। এতে কাজের মান ও দর নিয়ে অনেক সময় প্রশ্ন ওঠে। এ ক্ষেত্রে দরপত্রের মাধ্যমে একাধিক দরদাতার দর দেখার সুযোগ থাকে না।
গত বছরের ডিসেম্বরে সীমিত দরপত্রপদ্ধতিতে (এলটিএম) রাজি হয়েছে চীন। এতে শুধু চীনা ঠিকাদারেরা অংশ নেবেন। এই পদ্ধতিতে এখনো কোনো প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয়নি।
এ ছাড়া চীনা ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমাও বেশ কম। গ্রেস পিরিয়ড বাদ দিলে ১০-১৫ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এতে প্রতিটি কিস্তিতে অর্থের পরিমাণ বেশি হয়, যা সার্বিক ঋণ পরিশোধে চাপ সৃষ্টি করে।
আবার চীনা ঋণের সুবিধা হলো, এটির সুদের হার স্থির থাকে। সেবা মাশুলসহ এই ঋণের সুদের হার ২ থেকে সোয়া ২ শতাংশ হয়ে থাকে।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) অন্যান্য দাতা সংস্থার কাছ থেকে ঋণ পাওয়া যায় নমনীয় শর্তে। এসব সংস্থার ঋণের সুদহার তুলনামূলক সুদহারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড এসওএফআর অনুযায়ী ওঠানামা করে। সব মিলিয়ে এই ঋণের সুদের হার ২ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তবে তাদের ঋণ পরিশোধের সময়সীমা অনেক বেশি, ৩০ থেকে ৪০ বছর সময় পাওয়া যায়। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ধরা যাক, চীন থেকে ২ শতাংশ সুদে ৩০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়া হলো।
একই সুদে বিশ্বব্যাংক থেকেও ৩০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়া হলো। চীনের ঋণ পরিশোধ করতে হবে ১৫ বছরের মধ্যে। প্রতিবছর যদি একটি কিস্তি হয়, তাহলে প্রতি কিস্তিতে ২ কোটি ডলার আসল পরিশোধ করতে হবে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের ঋণ ৩০ বছর পরিশোধ করা হলে প্রতিবছর এক কোটি ডলার আসল পরিশোধ করতে হবে। এ জন্যই বলা হয়, চীনা ঋণ পরিশোধে চাপ বেশি।