মিকাত হলো নির্ধারিত সীমারেখা। হজ ও ওমরাহর দুই ধরনের মিকাত আছে। (১) মিকাতে জামানি (সময়ের মিকাত) (২) মিকাতে মাকানি (স্থানের মিকাত)। সময়কেন্দ্রিক মিকাত হলো তিনটি—শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ মাস।
তবে কিছু আলেমের মতে, এটি ১০ জিলহজ পর্যন্ত। ওমরাহর মিকাতের সময় বছরের যেকোনো সময়। স্থানগত মিকাত পাঁচটি। হজ ও ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা গমনকারীদের পবিত্র কাবা থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্ব থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়, ওই জায়গাগুলোকে পরিভাষায় মিকাত (স্থানগত সীমানা) বলা হয়।
মিকাতের জন্য পাঁচটি নির্ধারিত স্থান আছে। মহানবী (সা.) এসব স্থান নির্ধারণ করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মিকাত নির্ধারিত করেছেন—মদিনাবাসীর জন্য জুলহুলাইফা, সিরিয়াবাসীর জন্য জুহফা, নজদবাসীর জন্য কারনুল মানাজিল এবং ইয়েমেনবাসীর জন্য ইয়ালামলাম নামক স্থান। (বুখারি, হাদিস : ১৫২৪, ১৫২৬, মুসলিম, হাদিস : ১১৮১)
আর রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরাকবাসীর জন্য ‘জাতু ইরক’ মিকাত নির্ধারণ করেন।(আবু দাউদ, হাদিস : ১৭৩৯)
মিকাতের প্রাচীন ও আধুনিক নাম
প্রথম মিকাত জুলহুলাইফা। এ স্থানটি এখন ‘আবইয়ারে আলী’ নামে পরিচিত। এটি মসজিদে নববী থেকে ১০ কিমি দূরে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এবং মক্কা শহর থেকে ৪২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মদিনাবাসী এবং এ পথ দিয়ে যারা আসে—তারা এখান থেকে ইহরাম বাঁধবে। মক্কা শহর থেকে এটাই সবচেয়ে দূরতম মিকাত।
দ্বিতীয় মিকাত আল জুহফা। এ জায়গাটি লোহিত সাগর থেকে ১০ কিলোমিটার ভেতরে ‘রাবেগ’ শহরের কাছে। জুহফাতে বর্তমানে চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। তাই ‘রাবেগ’ নামক স্থান থেকে এখন লোকেরা ইহরাম পরে। জম্মুম উপত্যকার পথ ধরে মক্কা শহর থেকে এ স্থানটি ১৮৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখান থেকে ইহরাম বাঁধবে নিম্নোক্ত দেশের লোকেরা : সিরিয়া, লেবানন, জর্দান, ফিলিস্তিন, মিসর, সুদান, মরক্কো, আফ্রিকার দেশগুলো সৌদি আরবের উত্তরাঞ্চলীয় কিছু এলাকাবাসী, যারা মদিনার পথ ধরে যারা আসে না, তারাও এখান থেকে ইহরাম বাঁধবে।
তৃতীয় মিকাত ‘কারনুল মানাজিল’। বর্তমানে এটি ‘আস সাইলুল কাবির’ নামে প্রসিদ্ধ। মক্কা থেকে এর দূরত্ব ৭৮ বা ৮৫ কিলোমিটার। এখান থেকে ইহরাম বাঁধবে নিম্নোক্ত দেশের লোকেরা : (ক) রিয়াদ, দাম্মাম ও তায়েফ (খ) কাতার (গ) কুয়েত (ঘ) আমিরাত (ঙ) বাহরাইন (চ) ওমান (ছ) ইরাক (জ) ইরানসহ উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো।
কারনুল মানাজিলের অন্তর্ভুক্ত ‘ওয়াদি মুহরিম’ নামে দ্বিতীয় আরেকটি স্থান থেকে লোকেরা ইহরাম বাঁধে। এটা তায়েফ-মক্কা রোডে ‘হাদা’ এলাকা হয়ে মক্কা গমনের পথে মক্কা থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানে সর্বাধুনিক ও বৃহদাকার মসজিদ, অজু-গোসল ও গাড়ি পার্কিংয়ের পর্যাপ্ত সুবিধা আছে। এটা নতুন মিকাত নয়; বরং ‘কারনুল মানাজিল’-এর অংশবিশেষ।
চতুর্থ মিকাত ‘ইয়ালামলাম’। এটি একটি উপত্যকার নাম। এ জায়গা মক্কা শরিফ থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এলাকাটি বর্তমানে ‘সাদিয়া’ নামেও পরিচিত। এখান থেকে ইহরাম বাঁধবে নিম্নোক্ত দেশের লোকেরা : (ক) ইয়েমেন, (খ) বাংলাদেশ, (গ) ভারতবর্ষ, (ঘ) চীন, (ঙ) ইন্দোনেশিয়া, (চ) মালয়েশিয়া, (ছ) দক্ষিণ এশিয়াসহ পূর্ব দিকের দেশগুলো।
পঞ্চম মিকাত ‘জাতু ইরক’। এটা মক্কা শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি এখন আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। এটা ছিল ইরাকবাসীদের মিকাত। তারা এখন তৃতীয় মিকাত ‘আস সাইলুল কাবির’ ব্যবহার করে।
মিকাতের মাসায়েল
হজ ও ওমরাহর উদ্দেশে মক্কায় গমনকারীর জন্য ইহরাম না বেঁধে মিকাত অতিক্রম করা বৈধ নয়। যদি কোনো ব্যক্তি ইহরাম না বেঁধে মিকাত অতিক্রম করে ভেতরে চলে আসে তার উচিত মিকাতে ফিরে গিয়ে ইহরাম বাঁধা। এ অবস্থায় তার ওপর ক্ষতিপূরণ হিসেবে ‘দম’ দেওয়া ওয়াজিব হবে না। তবে মিকাতে ফিরে না গিয়ে যেখানে আছে সেখান থেকে ইহরাম বাঁধলে হজ ও ওমরাহ হয়ে গেলেও তার ওপর ‘দম’ দেওয়া ওয়াজিব হবে।
আর যারা মিকাতের ভেতরে বসবাস করে তাদের মিকাত হচ্ছে নিজ নিজ গৃহ। সুতরাং তারা নিজ বাসস্থান থেকেই ইহরামের নিয়ত করবে। এমনকি মক্কাবাসীরা মক্কা থেকেই ইহরাম করবে, তবে ওমরাহর ক্ষেত্রে হারাম এলাকায় বসবাসকারীরা ইহরাম বাঁধার উদ্দেশ্যে নিকটবর্তী হালাল এলাকায় গমন করবে। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মিকাতের ভেতরের লোকেরা নিজ বাড়ি থেকে ইহরাম বাঁধবে। এমনকি মক্কাবাসীরা মক্কা থেকেই ইহরাম বাঁধবে।’ (বুখারি, হাদিস : ১৫২৪)
স্মরণ রাখতে হবে যে মসজিদে আয়েশা মিকাত হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। এটি মক্কার তানঈম এলাকায় অবস্থিত। হারাম এলাকার বাইরে ইহরাম বেঁধে ওমরাহ করার ক্ষেত্রে এটি সর্বাধিক নিকটবর্তী স্থান। মক্কা থেকে সাড়ে সাত কিলোমিটার উত্তরে মক্কা-মদিনা রোড ‘তারিক আল হিজরাহ’তে এটি অবস্থিত। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) এখান থেকে ওমরাহর ইহরাম বেঁধে ওমরাহ করেছিলেন। পরে সেখানে একটি বিশাল মসজিদ গড়ে ওঠে। যা ‘আয়েশা মসজিদ’ নামে প্রসিদ্ধ। বিদেশি হজযাত্রীরা কোনো সফরের দ্বিতীয়-তৃতীয় ওমরাহর জন্য ওখান থেকে ওমরাহর ইহরাম বেঁধে থাকেন। যদিও এটি সবার জন্য আলাদা মিকাত হিসেবে নবীযুগে নির্ধারিত হয়নি।
উল্লেখ্য যে শায়খ আবদুল আজিজ বিন বাজ (রহ.), শায়খ সালেহ আল উসায়মিন (রহ.) ও শায়খ আলবানি (রহ.) হজের সফরে একাধিক ওমরাহ করাকে বিদআত ও নাজায়েজ বলেছেন। (দলিলুল হাজ্জ ওয়াল মুতামির, মাসআলা-২৪, পৃষ্ঠা ৬৫)
আর যারা একাধিক ওমরাহ করতে চান, তারা হারামের সীমানার বাইরে ‘জিরানা’ নামক স্থানে গিয়েও ইহরাম বেঁধে আসেন। সেখানে বর্তমানে একটি মসজিদ আছে। অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয় ও হুনাইন যুদ্ধের পর রাসুল (সা.) ‘জিরানা’ থেকে ওমরাহ আদায় করেছেন।