ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে ভয়াবহ বন্যার শঙ্কা

  প্রিন্ট করুন   প্রকাশকালঃ ১৮ আগu ২০২৫ ০৪:০০ অপরাহ্ণ   |   ৪৫ বার পঠিত
ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে ভয়াবহ বন্যার শঙ্কা

আবুল কালাম আজাদ:-



বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা উজানের ঢলে দেশে নদ-নদীতে পানি বাড়ছে।

আগস্টের শেষ ভাগ ও সেপ্টেম্বরে ভয়াবহ বন্যার শঙ্কায় দেশ। বিশেষ করে তিস্তা পদ্মা ও যমুনার পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বিপৎসীমার কাছাকাছি বা এর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি জেলায় ডুবে গেছে ফসলি জমি, ঘরবাড়ি ও চরাঞ্চল।

 

পদ্মা-যমুনা,তিস্তা,সহ দেশের বড় বড় নদনদীর পানি বাড়ছে প্রতিদিন। এরই মাঝে বেশকিছু নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইছে। নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, পাবনা, মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকার নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটসহ দেশের কয়েকটি জেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে আগেই। বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে নদনদী সংলগ্ন আরো কিছু জেলায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রাজধানী ঢাকার আশপাশের কিছু জেলায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। 

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ,পদ্মার পানি বিপৎসীমার কাছে,  আশপাশের এলাকা ডুবছে।  রাজবাড়ীতে  পানি বৃদ্ধি অব্যাহত পানি বৃদ্ধি । বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসংলগ্ন নিচু এলাকায় নতুন করে পানি ঢুকছে । পদ্মা তীরবর্তী  বালিয়াকান্দি, কালুখালী, গোয়ালন্দ,সদর  উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নে  নতুন করে পানি প্রবেশ করছে।  পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায়  সদ্য আবাদী রোপা আমন ধান, সবজি, মরিচসহ বিভিন্ন ফসলি জমি তলিয়ে ফসল নষ্ট হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মার দোলতদিয়া গেজ স্টেশন পয়েন্টে ৮ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে ৮.০৪ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মার দৌলতদিয়া অংশে পানির বিপৎসীমা ৮.২০ সেন্টিমিটার।
 

ভারতের আসাম, মেঘালয় এবং পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার, জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলায় ভারি থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর প্রভাবে ১৮ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর পানি দ্রুত বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে রংপুর বিভাগের তিস্তা, দুধকুমার ও ধরলা নদীর পানির উচ্চতা বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে।

 

বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের প্রভাবে দেশের উপকূলীয় এলাকা ও সমুদ্র বন্দরগুলোর উপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার আশংকা করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
 

সেই সাথে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
 

১৮ আগস্ট এক সতর্কবার্তায় আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছেন, উত্তর অন্ধ্র প্রদেশ ও দক্ষিণ ওড়িষ্যার উপকূলের অদূরে পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উত্তর পশ্চিম-বঙ্গোপসাগর এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে।

 

বৃষ্টি ও উজানের ঢলে পানি বাড়ছে যমুনায়।  বৃষ্টি ও উজানের ঢলে  যমুনা নদীতে পানি বাড়ছে। গত ৪৮ ঘণ্টায় দ্রুতগতিতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে যমুনার পানি বিপৎসীমার কাছে চলে এসেছে। যমুনায় পানি বাড়ার কারণে সিরাজগঞ্জের ফুলজোড়, করতোয়া, হুড়া সাগরসহ অন্যান্য নদনদীতেও পানি বাড়ছে। চরাঞ্চলের ফসলি জমি তলিয়ে গেছে।  যমুনার পানি ২৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৪৩ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ।  সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়নের কাটাঙ্গা গ্রামের কৃষক সামছুল শেখ বলেন, কয়েকদিন ধরে পানি বাড়তে থাকায় চরাঞ্চলের আবাদি জমি তলিয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। নিচু এলাকার জনবসতি জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। রোপা আমন ধান, সবজি, মরিচসহ বিভিন্ন ফসল নষ্ট হচ্ছে।
 

আত্রাই নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ঢুকছে পানি : নওগাঁর আত্রাই নদীর একটি স্থানে কয়েক সেন্টিমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ঢুকতে শুরু করেছে পানি। গতকাল শনিবার সকালে মান্দা উপজেলার কসব ইউনিয়নের তালপাতিলা এলাকায় আত্রাই নদীর এ বেড়িবাঁধটি ভেঙে যায়। এতে তালপাতিলা গ্রামসহ আশপাশের চকবালু, চকরামপুরসহ কয়েকটি গ্রামে পানি প্রবেশ করে। এতে করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন শতাধিক পরিবার। স্থানীয়রা বলছেন, এ একই স্থান গত বছর বন্যার পানিতে ভেঙে গিয়েছিল। এরপর মাসখানেক আগে বেড়িবাঁধের এ অংশটুকু মেরামত করা হয়। কিন্তু নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আবারও অংশটি ভেঙে গেছে।

 

এদিকে নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, আত্রাই নদীর পানি মান্দা উপজেলার জোত বাজার পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ও রেলওয়ে ব্রিজ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া নওগাঁর ছোট যমুনা ও পুনর্ভবা নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে থাকলেও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
 

আত্রাই নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হওয়ায় মান্দা উপজেলার চকরামপুর, উত্তর চকরামপুর, কয়লাবাড়ী, জোকাহাট, দ্বারিয়াপুর, নুরুল্লাবাদ, পারনুরুল্লাবাদ ও তালপাতিলা এলাকার অন্তত ১০টি বেড়িবাঁধকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ মূল বাঁধের লক্ষ্মীরামপুর, আয়াপুর, পাঁজরভাঙ্গা, পলাশবাড়ী, মিঠাপুর, নিখিরাপাড়া ও গোয়ালমান্দাসহ অন্তত ২০টি পয়েন্টকে উচ্চঝুঁকির তালিকায় রাখা হয়েছে। লাগাতার ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে আত্রাইয়ে নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে ছোট যমুনা ও আত্রাই নদীর পানি আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই মধ্যে আত্রাই নদীর দুটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
 

নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, লাগাতার ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার ফলে নওগাঁর আত্রাই উপজেলার পতিসর-সমসপাড়া পাকা রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ওই এলাকার কয়েক গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। রাস্তার ওপর হাঁটুসমান পানি হওয়ায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধির ফলে নিম্নভূমি বাহাদুরপুর, দমদত্তবাড়িয়া, হিঙ্গুলকান্দি, জগন্নাথপুরসহ কয়েক গ্রামের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
 

আত্রাই নদীর রেলওয়ে ব্রিজ পয়েন্টে পানি সমতল বিপৎসীমার ৩১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ার পর থেকেই উপজেলার ঝুঁকিপূর্ণ রসুলপুর, সদুপুর, লালুয়া, বেওলা, নন্দনালী, জগদাস, শিকারপুর, ডুবাই, গুরনৈসহ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের মানুষেরা ভয়ে, আতঙ্কে দিন পার করছেন। ফুঁসছে তিস্তা আগ্রাসী রূপ নিয়েছে বন্যার শঙ্কা । এরই মধ্যে রংপুরে তিস্তা সেতুর রক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দেওয়ায় ৩০ লাখ মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তিস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।  জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুরে তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় সড়ক সেতুর পশ্চিম তীরে সেতু রক্ষা বাঁধের প্রায় ৬০ মিটার এলাকা ধসে পড়েছে। এতে বাঁধে প্রায় ৭০ ফুট গভীর গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। কয়েক দিনের লাগাতার বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় তীব্র স্রোতের ধাক্কায় পুরো বাঁধই এখন ঝুঁকির মুখে। স্থানীয়রা বলছে, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে সেতু ও সংলগ্ন রংপুর-লালমনিরহাট মহাসড়ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।  তিস্তা সেতুর পশ্চিম পাশের প্রায় ৯০০ মিটার দীর্ঘ সেতু রক্ষা বাঁধের বিভিন্ন অংশে স্রোতের তীব্রতা বেড়েই চলছে।
 

এর ফলে বাঁধের নিচের মাটি ধুয়ে গিয়ে ব্লকগুলো ধসে পড়ছে এবং বাকি অংশও ধীরে ধীরে দেবে যাচ্ছে। তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী, আলমবিদিতর, কোলকোন্দ, লক্ষ্মীটারী, গজঘণ্টা ও মর্নেয়া ইউনিয়ন, কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, টেপামধুপুর ইউনিয়ন এবং পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নে তিস্তার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর, দ্বীপচরের ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। বন্যার আশঙ্কায় অনেকে ঘরবাড়ি নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। অপরদিকে  ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বিকেল ৩টায় তিন সেন্টিমিটার কমে ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

 

তিস্তার পানি বৃদ্ধির ফলে জেলার ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ী, টেপাখড়িবাড়ী, খালিশা চাপানী, ঝুনাগাছ চাপানী, গয়াবাড়ী ও জলঢাকা উপজেলার গোলমুণ্ডা, ডাউয়াবাড়ী, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে করে এসব ইউনিয়নের অন্তত ২৫ গ্রামের ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়েছে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢলে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
 

কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে গত কয়ক দিনের টানা বৃষ্টি আর ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উপজেলার দুধকুমার, ফুলকুমার ও কালজানীসহ সব নদ-নদীর পানি বেড়েছে। বিপৎসীমার ছয় সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে দুধকুমার নদের পানি। নদীতীরবর্তী এলাকা ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে সদর ইউনিয়নের নলেয়া, চরভূরুঙ্গামারী ইউনিয়নের ইসলামপুর, পাইকেরছড়া ইউনিয়নের পাইকেরছড়া, পাইকডাঙ্গা, আন্ধারীঝাড় ইউনিয়নের চর ও বীর ধাউরারকুঠি, তিলাই ইউনিয়নের দক্ষিণ তিলাই ও শিলখুড়ি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
 

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার গোতামারী ইউনিয়নের দক্ষিণ গোতামারী এলাকার একটি রাস্তা পানিতে তলিয়ে গিয়ে দুর্ভোগে পড়েছে দুই ইউনিয়নের মানুষ। গোতামারী ও নওদাবাস ইউনিয়নের বাইপাস সংযোগ সড়কটি পানিবন্দি হয়ে পড়ায় চিকিৎসা নিতে যাওয়া বৃদ্ধা আনোয়ারা বেগমকে কলাগাছের ভেলায় করে পার করছে স্থানীয়রা। জানা গেছে, কয়েক দিনের ভারি বৃষ্টির কারণে গোতামারী ও নওদাবাস ইউনিয়নের একমাত্র সংযোগ সড়কটি পানিতে তলিয়ে গেছে। সড়কটি পানিবন্দি হয়ে পড়ায় দুই ইউনিয়নের প্রায় ১০ হাজার মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে। মানুষের পাশাপাশি গবাদি পশুর খাবার সংকটে পড়েছে। রোপণকৃত আমন ধান পানিতে তলিয়ে নষ্ট হচ্ছে। পানিবন্দি পরিবারগুলো বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটে পড়েছে।