মহামারি থেকে মুক্ত হলেও মিলেনি জীবনের নিরাপত্তা। অশ্রু, ক্ষুধা ও মৃত্যুর বছর হিসেবে এ বছরটি ইতিহাসের পাতায় থাকবে রঙিন হয়ে। সব মিলিয়ে শান্তির প্রত্যাশায় আশা-দুরাশায় কেটেছে মুসলিম বিশ্বের এ বছর। মুসলিম নেতাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতাসহ বিশেষ ঘটনাগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-
স্বাভাবিক রূপে পবিত্র হজ : কভিড-১৯ মহামারির কারণে গত তিন বছর সীমিত পরিসরে পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হয়।
২০২০ সালে কঠোর বিধি-নিষেধ মেনে আনুমানিক ১০ হাজার, ২০২১ সালে ৬০ হাজার ও ২০২২ সালে ১০ লাখ মুসলিম হজ পালন করে। ২০২৩ সালে করোনা-পূর্ব পরিস্থিতির মতো পূর্ণাঙ্গ ধারণক্ষমতা ব্যবহার করে হজ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫ জন অংশ নেন। তা ছাড়া এবার ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশের যুদ্ধাহতদের হজ করার ব্যবস্থা করেছে সৌদি আরব।
ওমরাহ ভ্রমণ সহজীকরণ : হজ ও ওমরাহ ভ্রমণ সহজ করতে প্রযুক্তিনির্ভর সেবা বাড়িয়েছে সৌদি আরব। গত ২৪ আগস্ট ঢাকায় সমন্বিত ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ‘নুসুক’ অ্যাপ চালু করে দেশটির প্রতিনিধিদল। এর মাধ্যমে এজেন্সি ছাড়াই ই-ভিসা নেওয়া যাবে এবং ফ্লাইট ও হোটেল বুকিং দেওয়া যাবে। এমনকি সৌদিয়া এয়ারলাইনসে ৯৬ ঘণ্টার ট্রানজিট বা স্টপওভার ভিসা নিয়েও ওমরাহ পালন করা যায়।
ফলে ঝামেলা ছাড়াই স্বাচ্ছন্দ্যে মক্কা, মদিনাসহ বিভিন্ন শহর ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে। তা ছাড়া ওমরাহ ভিসার মেয়াদ ৩০ দিন থেকে বাড়িয়ে ৯০ করা হয়।
কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ : এবারও আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি হাফেজরা সাফল্য দেখিয়েছে। গত ৪ এপ্রিল দুবাই আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে আড়াই লাখ দিরহাম (প্রায় ৭১ লাখ ৭০ হাজার ৮৯৪ টাকা) পুরস্কার পায় বাংলাদেশের সালেহ আহমেদ তাকরিম। সে গত বছর ইরানে প্রথম এবং মক্কায় তৃতীয় হয়েছিল।
তা ছাড়া এ বছরের ৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সৌদি আরবের ৪৩তম আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান অধিকার করেছে যথাক্রমে ফয়সাল আহমেদ ও মো. মুশফিকুর রহমান। ফয়সাল এক লাখ ৮০ হাজার সৌদি রিয়াল পুরস্কার পায়।
কোরআন অবমাননা রোধে আইন : চলতি বছরের শুরু থেকে বেশ কয়েকবার ডেনমার্ক, সুইডেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে বাকস্বাধীনতার অজুহাতে পবিত্র কোরআনের কপি পোড়ানোর ঘটনা ঘটে। এমন ঘৃণ্য কাজের নিন্দা জানিয়ে তা নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানায় অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি), মিসরের আল-আজহারসহ মুসলিম দেশগুলো। অতঃপর ধর্মীয় বিদ্বেষ রোধে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ (ইউএনএইচআরসি) এবং সাধারণ পরিষদ ধর্মীয় গ্রন্থের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে একটি নিন্দা প্রস্তাব পাস করে। অবশেষে গত ৭ ডিসেম্বর কোরআন পোড়ানোসহ এর সঙ্গে অনুপযুক্ত আচরণ অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করে একটি আইন পাস করে ডেনমার্কের পার্লামেন্ট। আইন অনুসারে অপরাধীকে সর্বোচ্চ দুই বছরের সাজার পাশাপাশি জরিমানাও করা হবে।
সৌদি-ইরান স্বাভাবিক সম্পর্ক : দীর্ঘ সাত বছর পর গত ১০ মার্চ চীনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সৌদি আরব ও ইরানের স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এরপর ৬ জুন রিয়াদে ইরান দূতাবাস এবং ৯ আগস্ট তেহরানে সৌদি দূতাবাস খোলা হয়। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় কূটনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি উভয় দেশের মধ্যে বেশ কয়টি বাণিজ্যিক চুক্তি হয়। সিরিয়া, ইয়েমেন, লেবানন ও ইরাকের প্রক্সি যুদ্ধের অবসানের আশা করা হলেও সর্বশেষ ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ পুরো অবস্থাকে বদলে দেয়।
এক যুগ পর আরব বলয়ে সিরিয়া : ২০১১ সালে আরব বসন্তের আগুন থামাতে গিয়ে আরব লিগের সদস্য পদ হারায় সিরিয়া। সদস্য পদ ফিরে পেয়ে গত ১৯ জুন সৌদি আরবের রিয়াদে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন বাসার আল-আসাদ। দীর্ঘ এক যুগ রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকার পর পুনরায় সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে জর্দানের পাশাপাশি মিসর, ইরাক, সৌদি আরব কূটনীতিকরা বিশেষ ভূমিকা রাখে।
ইয়েমেনে শান্তির প্রচেষ্টা : ইয়েমেনে প্রায় ৯ বছর ধরে চলা প্রক্সি যুদ্ধ অবসানের চেষ্টা করা হচ্ছে। সৌদি আরব-ইরানের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক হওয়ার পর থেকে এ প্রচেষ্টা আরো সুদৃঢ় হয়। এ নিয়ে ওমানের মধ্যস্থতায় উভয় দেশের প্রতিনিধিদলের মধ্যে বৈঠক হয় এবং বন্দি বিনিময়ের চুক্তি হয়। তা ছাড়া ২০১৬ সালের পর এ বছরই প্রথম এ বিমানবন্দর দিয়ে ইয়েমেনি হজযাত্রীরা সৌদি আরব যাওয়ার সুযোগ পান। তা ছাড়া যুদ্ধাহত অনেককে নিজস্ব খরচে হজ করতে নিয়ে যায় সৌদি আরব। জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশটিতে সংঘাতে জড়িত সব পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে সায় দিয়েছে। আশা করা হচ্ছে, শিগগিরই বিশ্বের সবচেয়ে মানবিক সংকট তৈরি করা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে।
তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে মৃত্যু : গত ৯ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ৭.৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়। এতে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। যার মধ্যে ৫০ হাজার ৭৮৩ জন তুরস্কের এবং আট হাজার ৪৭৬ জন সিরিয়ার রয়েছে। এদিকে গত ১০ সেপ্টেম্বর লিবিয়ার উত্তর-পূর্ব উপকূলে ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েলের আঘাতে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়। ডেরনা শহরের দুটি বাঁধ ভেঙে তৈরি হওয়া ভয়াবহ বন্যায় ১২ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায় এবং প্রায় ১০ হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়।
গাজায় মৃত্যুর মিছিল : গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে ইসরায়েল। হামাসের হামলা শুরু হওয়া এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৫০৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়; যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি শিশু ও নারী রয়েছে। অবশ্য গত ২৪ নভেম্বর থেকে সাত দিন যুদ্ধবিরতির পর পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়। এদিকে গত ২৯ ডিসেম্বর গাজায় গণহত্যার অপরাধে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মামলা করে দক্ষিণ আফ্রিকা। এই বিষয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের সুরক্ষায় অবিলম্বে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানায় দেশটি।
আল-আকসায় প্রবেশে বিধি-নিষেধ : গত তিন মাস যাবৎ জুমা পড়তে আসা ৬৫ বছরের কম বয়সী মুসল্লিদের জেরুজালেমের পবিত্র মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরায়েলি পুলিশ। গত ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে টানা ১২ সপ্তাহ ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর নানা ধরনের বিধি-নিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। ফলে পবিত্র এ মসজিদ ও এর আশপাশের চত্বর প্রায় মুসল্লিশূন্য দেখা যায়। এমনকি নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিদের আশপাশের সড়কে নামাজ পড়তে বাধ্য করা হয় এবং তাদের ওপর দুর্গন্ধযুক্ত পানি ছিটানো হয়।
গাজার পক্ষে মার্কিন মুসলিমদের অবস্থান :
গাজা ইস্যুতে দৃঢ় অবস্থান নেয় যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমরা। সমরাস্ত্রসহ নানা সহযোগিতার মাধ্যমে ইসরায়েলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন করায় তারা দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে আসন্ন নির্বাচনে সমর্থন না করার ঘোষণা দেয়। এর মধ্যে মিশিগান, মিনেসোটা, আরিজোনা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যের ভোটাররা ডেমোক্র্যাটকে সমর্থন করা থেকে বিরত থাকবে বলে জানায়।
তথ্যসূত্র : আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম অবলম্বনে