ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি

প্রকাশকালঃ ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৪:২৯ অপরাহ্ণ ২৪৪ বার পঠিত
ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি

মাত্র দেড় বছর আগেই ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার জেরে দেশটিতে ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছিল, যার পরিণতিতে শ্রীলঙ্কার সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। দেশ ছাড়তে হয়েছিল দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপকসেও।

বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত হয়ে সেসময় এমন অবস্থা হয়েছিল যে, শ্রীলঙ্কা আর আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছিল না। এর জের ধরে খাদ্য, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল। তেলের স্টেশনে দীর্ঘ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত মানুষকে। সে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে দেশটি এবং জমে উঠতে শুরু করেছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি পর্যটন খাত এবং জ্যামিতিক হারে বাড়ছে দেশটির রেমিট্যান্স। এ ধারা অব্যাহত থাকলে শিগিগরই দেশটির অর্থনীতি আরো শক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। 

কলম্বোর সাংবাদিক শিহার আনিজ বিবিসিকে বলেন, দোকানে পণ্য নেই কিংবা কিছু থাকলেও অনেক দাম, অথচ মানুষের দীর্ঘ লাইন— বিপর্যয়কর সেই অবস্থা এখন আর নেই শ্রীলঙ্কায়। বরং দাম বেশি থাকলেও নিত্য দরকারি সব কিছুর সরবরাহ এখন বাজারে স্বাভাবিক হয়েছে। জীবনযাত্রাও সে সময়ের তুলনায় এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। যদিও তিনি মনে করেন সংকট থেকে এখনো পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারেনি দেশটি। বরং প্রকৃত অবস্থা কী হয় সেটা বোঝা যাবে, যখন দেশটি বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা শুরু করবে।


কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক প্রিয়াংঙ্গা দুনুসিংহে বলছেন, সরকারি নীতি আর কিছু অটোমেটিক বিষয়ের সমন্বয়েই পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছে শ্রীলঙ্কা। এর কারণ হিসেবে দুটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন তিনি। তার মতে, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতি পরিস্থিতির উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে। এর ফলে রেমিট্যান্স ও পর্যটনের মতো কিছু ক্ষেত্রে অটোমেটিক রিকাভারি হয়েছে। সরকার ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব বাড়িয়েছে এবং সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করে করজাল বিস্তৃত করেছে—এর ফলও অর্থনীতিতে দেখা যাচ্ছে।

শ্রীলঙ্কার সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর জুলাইতে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। কমেছে খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি। অথচ বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের সংকটকালে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৪৯ শতাংশের বেশি। মূলত কোভিড মহামারির ধাক্কায় দেশটির পর্যটন খাত ধসে পড়ায় এবং একই সঙ্গে প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেলে ২০২২ সালের শুরুতে ভয়ংকর সমস্যায় পড়ে দেশটি। সঙ্গে যোগ হয় ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের কারণে পণ্য আমদানির ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, যা আর দেশটি সামাল দিতে পারেনি।

এ সংকটের জের ধরে নজিরবিহীন গণবিক্ষোভের মুখে ২০২২ সালের ১৩ জুলাই ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। এরপর নানা ঘটনার ধারাবাহিকতায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে দেশটির দায়িত্ব নেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর কিছু কিছু খাতে সংস্কারের পাশাপাশি আইএমএফের সঙ্গে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের একটি বেইল আউট প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন বিক্রমাসিংহে। চলতি বছরের মার্চে আইএমএফ বোর্ড সেটি অনুমোদন করে। এরপর খাদ্য মূল্য, বিদ্যুতের দাম সামান্য কমানোর চেষ্টা করে জনজীবন সহজ করার চেষ্টা করে সরকার। এবং এর অংশ হিসেবে ২৩ লাখ অতি দরিদ্র পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়।


সাংবাদিক শিহার আনিজ এবং অধ্যাপক প্রিয়াঙ্গা দুনুসিংহে—দুই জনেই বলেছেন যে, পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার শুরু থেকেই ব্যয় কমানোর চেষ্টা করেছে ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। আবার গত বছর বিদেশে কর্মী পাঠানো অতীতে সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। যাদের অনেকেই ডাক্তার, প্যারামেডিক্যাল কিংবা আইটি প্রফেশনাল।

অধ্যাপক প্রিয়াংঙ্গা দুনুসিংহে মনে করেন, শ্রীলঙ্কা আপাতত পরিস্থিতিকে সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে। অবশ্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৩ সালেও জিডিপি হ্রাসের প্রবণতায় থাকবে শ্রীলঙ্কা। তবে ২০২৪ সাল থেকে ধীরে ধীরে এটি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে। যদিও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ ও দেশের বাইরে থেকে শ্রীলঙ্কার এখন মোট ঋণের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। কোনো কোনো সংস্থার হিসাবে এই ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি শোধ করতে হবে চীন, জাপান এবং ভারতকে। আবার মোট ঋণের মধ্যে ২৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করতে হবে ২০২৭ সালের মধ্যে। সরকার ঋণ পুনর্বিন্যাসের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশ ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। আলোচনা সফল হলে ঋণ ভার কিছুটা হলেও লাঘব হবে দেশটির। 

শিহার আনিজ বলছেন, কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও বিদেশি ঋণ পরিশোধ কার্যক্রম কিন্তু এখনো শুরু হয়নি। সেটি যখন শুরু হবে তখন আসলে বোঝা যাবে আমাদের অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারল।