বিদেশি ঋণের সুদে করছাড়ের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা

প্রকাশকালঃ ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ০২:১৬ অপরাহ্ণ ০ বার পঠিত
বিদেশি ঋণের সুদে করছাড়ের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা

ঢাকা প্রেস নিউজ
 

এই মাসের শেষেই শেষ হতে যাচ্ছে বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধে ২০ শতাংশ করছাড়ের বিশেষ সুবিধার মেয়াদ। আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে এ সুবিধা না পাওয়ার ফলে বিদেশি ঋণ নেওয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলোকে বার্ষিক প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ গুণতে হবে। এ পরিস্থিতি ব্যবসায়ীদের জন্য আগামীতে বড় চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করবে।
 

জানা যায়, ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদের ওপর ২০ শতাংশ উৎস কর আরোপ করা হয়, তবে ব্যবসায়ী মহলের অনুরোধে তা চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে।
 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা যায়, ডিসেম্বরের পর করছাড়ের মেয়াদ বৃদ্ধি পাবে না। তাই আগামী জানুয়ারি থেকে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের সময় স্বাভাবিক নিয়মে ২০ শতাংশ কর আদায় করা হবে।
 

এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, স্বাভাবিক হারে কর আদায় হলে এ খাত থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় হবে। তবে উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, বিশেষ সুবিধা বন্ধ হলে শিল্পায়নে বাধা সৃষ্টি হতে পারে এবং রিজার্ভ সংকটের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমে যেতে পারে।
 

দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান ডিবিএল গ্রুপের চারটি কোম্পানির বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০ কোটি ডলারেরও বেশি। গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ জব্বার বলেন, ‘‘বর্তমানে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা ভালো নয়। অতিরিক্ত কর আরোপ হলে আমাদের মুনাফার হার কমে যাবে এবং শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান ব্যাহত হতে পারে।’’
 

তিনি আরও বলেন, ‘‘২০ শতাংশ কর আরোপ করলে ঋণদাতারা তাদের নিট আয় ধরে রাখতে সুদের হার বাড়িয়ে দেবে। ফলে এই অতিরিক্ত ব্যয় আমাদেরই বহন করতে হবে।’’
 

ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের সঙ্গে একমত ব্যাংকাররাও। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘‘কর বাড়ালে বিদেশি ঋণ পাওয়া আরও কঠিন হয়ে যাবে। ঋণদাতারা এ করের বোঝা ঋণগ্রহীতাদের ওপর চাপিয়ে দেবে।’’
 

এনবিআর কর্মকর্তারা বলেন, ‘‘মূলত সুদের আয়ের ওপর কর আরোপ করা হবে, অর্থাৎ এই কর বহন করবে বিদেশি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান। তবে ঋণগ্রহীতারা যদি ঋণদাতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে পারেন, তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’’
 

দেশের ব্যাংকের চেয়ে বিদেশি ঋণের সুদহার কম হয়। বর্তমানে দেশীয় ব্যাংকের ঋণের সুদহার ১১ থেকে ১৫ শতাংশ হলেও বিদেশি ঋণের সুদহার ৪.৬০ থেকে ৫.১০ শতাংশ। ঋণদাতারা অতিরিক্ত ২ থেকে ৩ শতাংশ সুদ যোগ করে, ফলে বিদেশি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদের হার ৮ শতাংশ হয়ে থাকে।
 

তবে উদ্যোক্তারা বলেন, বিদেশি ঋণ চাইলেই পাওয়া যায় না। এজন্য কোম্পানিগুলোকে এনভায়রনমেন্ট, সোশ্যাল অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (ইএসজি) নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়।
 

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল বিনিয়োগকারী সমিতির সভাপতি এমএ জব্বার বলেন, ‘‘এ ধরনের ঋণ প্রাপ্তির শর্ত ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহিত করতে পারে। বিদেশি ঋণের ওপর কর বৃদ্ধি এ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে, যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমে যেতে পারে।’’
 

শাশা ডেনিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ‘‘বাংলাদেশে কিছু কিছু ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পাওয়া কঠিন, এবং বর্তমানে তো বেসরকারি খাত ঋণই পাচ্ছে না। তাই তৈরি পোশাক, অবকাঠামো ও প্রকৌশলের মতো কিছু খাতে বিদেশি ঋণ কার্যকর সমাধান হতে পারে।’’
 

ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সাবেক সভাপতি রূপালী চৌধুরী বলেন, ‘‘বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে অনেক কোম্পানি বেতন ও লভ্যাংশ পরিশোধেও হিমশিম খাচ্ছে। অতিরিক্ত করের চাপ দেওয়া অযৌক্তিক।’’
 

ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সুদের ওপর এনবিআরের অতিরিক্ত কর আরোপ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী বিএসআরএমও। ১১ ডিসেম্বর বিএসআরএমের মহাব্যবস্থাপক শেখর রঞ্জন কর এনবিআরকে একটি চিঠি পাঠিয়ে জানান, ‘‘বাংলাদেশের ব্যবসাগুলি বৈদেশিক মুদ্রার ঘন ঘন দর ওঠানামা, কাঁচামালের ক্রমবর্ধমান দাম, স্থানীয় অর্থায়নে সীমিত সুযোগ এবং এলসি নিশ্চিতকরণে বিদেশি ব্যাংকের বিলম্বসহ বিভিন্ন আর্থিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এসবের সঙ্গে বিদেশি ঋণের সুদের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ ব্যবসার সংকট আরও গভীর করছে।’’
 

এদিকে, এনবিআরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিদেশি ঋণদাতাদের সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) করছাড়ের সংস্কৃতি থেকে সরে আসতে চাপ দিচ্ছে, তাই ঋণগ্রহীতাদের এমন দেশ থেকে ঋণ নেওয়া উচিত, যেসব দেশের সঙ্গে দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি রয়েছে।