প্রকাশকালঃ
১০ জুলাই ২০২৪ ০৩:৫০ অপরাহ্ণ ৩১৩ বার পঠিত
দেশের শিল্প খাতের সংকট গভীর হচ্ছে। একদিকে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি মিলছে না, অন্যদিকে ডলারের দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি পাওয়ায় খরচের হিসাব মিলছে না। প্রতিনিয়ত খরচ বেড়ে যাওয়ায় কারখানা সচল রাখা নিয়ে হিসাব করতে হচ্ছে। এই সংকট যে অর্থনীতিতে পড়েছে, সেটি সরকারি পরিসংখ্যানেও উঠে এসেছে। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। বেসরকারি বিনিয়োগেও স্থবিরতা লক্ষ করা গেছে। ডলারের দাম বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। আগের হিসাবে বিনিয়োগ করে এখন ক্ষতির হিসাব গুনছেন উদ্যোক্তারা। ব্যাংকঋণের সুদহার বেড়ে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এর ফলে ভালো উদ্যোক্তারাও এখন খেলাপি হয়ে পড়ছেন।
উদ্যোক্তারা বলছেন, আমদানি কমিয়ে ডলার-বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অর্থনীতির জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমছে, সরকার রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি ব্যাংকের আয়ও কমে যাচ্ছে। অনেক বড় কোম্পানি মুনাফা বা বিনিয়োগের অর্থ ফেরত নিতে পারছে না। এসব কারণে নতুন শিল্প গড়ে উঠছে কম। কাঁচামাল আনতে না পেরে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো কারখানায় সক্ষমতার চেয়ে কম কার্যক্রম চালাচ্ছে। ফলে সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় খেলাপিতে পরিণত হয়ে পড়ছেন ভালো ঋণগ্রহীতারাও।
শিল্প খাতে উৎপাদন কমে যাচ্ছে :দেশের শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ। পরের ২০২১-২২ অর্থবছর এই হার ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমে আসে। তার পরের ২০২২-২৩ অর্থবছর নেমে আসে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং সদ্য বিদায়ি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে এই হার ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশে নেমে আসে; অর্থাৎ শিল্পে উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে। করোনার সময়ে দেশের অর্থনীতিতে স্থবিরতা থাকলেও বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা ছিল, পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
কিন্তু করোনা-পরবর্তী সময়ে বিনিয়োগ পরিবেশের অবনতি হয়েছে। তার প্রমাণ মিলছে ২০২৩-২৪ সালের ব্যবসার পরিবেশ-সূচকে (বিবিএক্স)। ২০২২ সালে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসা-পরিবেশের সূচকের ১০০ নম্বরের মধ্যে স্কোর ছিল ৬১ দশমিক ৯৫। গত বছর (২০২৩) সূচকের স্কোর কমে ৫৮ দশমিক ৭৫-এ নেমেছে; অর্থাৎ এক বছরে দেশে ব্যবসা-পরিবেশের অবনতি ঘটেছে। বিবিএক্স জরিপটি করেছে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এবং বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ। ঐ জরিপের তথ্যানুযায়ী, গত এক বছরে ব্যবসায়ীদের ব্যাংকঋণ পাওয়া আরও কঠিন হয়েছে।
ডলারের দর বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে :ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম এখন ১১৮ টাকা। বছর দুয়েক আগে ২০২২ সালের মে মাসেও ৮৬ টাকায় ডলার কেনা যেত। খুব দ্রুত মান হারিয়েছে টাকা, ফলে প্রচণ্ড চাপে পড়েছে দেশের শিল্প ও ব্যবসা-বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে দেশে ডলারের বিনিময়মূল্য ছিল গড়ে ৭ দশমিক ৩০ টাকা। পরবর্তীকালে ১৯৮১-৮২ অর্থবছর এই দর বেড়ে হয় ২০ দশমিক ০৬ টাকা। ১৯৯১-৯২ অর্থবছর ৩৮ দশমিক ১৪ টাকা, ২০০১-০২ অর্থবছর হয় ৫৭ দশমিক ৪৩ টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছর ৭৯ দশমিক ০৯ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছর ছিল ৮৬ দশমিক ৩০ টাকা আর বর্তমান দর উঠেছে ১১৮ টাকায়।
এর পরও খোলা বাজারে গতকাল ১২১ টাকায় ডলার কেনাবেচা হতে দেখা যায়। উদ্যোক্তারা বলছেন, প্রতি বছর ডলারের দাম যে হারে বাড়ছে, তাতে বিনিয়োগ-সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ ১০ বছর আগে ‘রেট অব রিটার্ন’ হিসাব করে যারা বিনিয়োগ করেছেন, বর্তমান বাজারমূল্যে সেটি ঠিক থাকছে না। আগের নেওয়া ঋণ এখন বর্তমান হিসাবে পরিশোধ করতে হচ্ছে। আগে একটি কারখানার পরিচালনায় চলতি মূলধন ১০০ কোটি টাকা লাগলে এখন লাগছে ১৬০ কোটি টাকা। কিন্তু কিছু ব্যাংক তার ঋণ-গ্রহণসীমা বাড়াচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচক নিয়েই বর্তমানে দুশ্চিন্তা রয়েছে। তার মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ অন্যতম। অনেক দিন ধরেই সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও বেসরকারি বিনিয়োগ সে তুলনায় বাড়ছে না। অর্থনীতির এই সংকটময় সময়ে বিনিয়োগ দ্রুতগতিতে বাড়ানো না গেলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হবে, বাড়বে বেকারের সংখ্যা। অন্যদিকে ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, বিভিন্ন কারণে ব্যবসার খরচ বেড়েছে। তবে ব্যবসা সেভাবে বাড়েনি। মূলধনঘাটতির কারণে বিদ্যমান ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডলার-সংকটে শিল্পে উৎপাদন যে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যেও উঠে এসেছে। সদ্য বিদায়ি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ১৭৭ কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়েছে। এটি তার আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ শতাংশ কম। একইভাবে শিল্পের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি কমেছে যথাক্রমে ৪ ও ১৬ শতাংশ।
বিদেশি বিনিয়োগে ভাটার টান :বেসরকারি বিনিয়োগের মধ্যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) গুরুত্বপূর্ণ। ২০২২ সালে দেশে ৩৪৮ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছিল। আর গত বছর ২০২৩ সালে এসেছে ৩০০ কোটি ডলার; অর্থাৎ গত বছর এফডিআই কম এসেছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ কিংবা ৪৮ কোটি ডলার। মোট এফডিআইয়ের মধ্যে মূলধন বা নতুন বিনিয়োগ, পুনর্বিনিয়োগও কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে যেখানে ১০২ কোটি ডলারের নতুন বিনিয়োগ এসেছিল, গত বছর (২০২৩) তা কমে ৭১ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। আর পুনর্বিনিয়োগ ২০২২ সালে ছিল ২৫১ কোটি ডলারের, গত বছর তা কমে হয়েছে ২২১ কোটি ডলার।
শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানির সংকট রয়েছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লোডশেডিং। রাজধানীর ঢাকায় বিদ্যুতের সংকট না থাকলেও ঢাকার বাইরে অবস্থা ভিন্ন। কয়েকটি কারখানার উৎপাদন-পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এ চিত্র দেখা যায়; যেমন ময়মনসিংহের ভালুকার একটি স্পিনিং মিলে জুন মাসে বিদ্যুতের লোডশেডিং ছিল প্রায় ৮৪ ঘণ্টা। দিনে গড়ে ছয় বার বিদ্যুৎ চলে যায়। বস্ত্র খাতের শিল্পমালিকদের বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) নেতারা সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে জ্বালানিসংকটের বিষয়গুলো তুলে ধরেন। তারা বলেন, বিগত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে জ্বালানিসংকটের কারণে বস্ত্র খাত স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। বিগত কয়েক মাস যাবত তীব্র গ্যাস-সংকটের কারণে মিলগুলো উৎপাদনক্ষমটার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করতে পারছে না। ডলার-সংকটের কারণে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল কমেছে।