প্রকাশকালঃ
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:৪০ অপরাহ্ণ ২৮৫ বার পঠিত
মাদরাসাগুলোর পাঠক্রম সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এটা সৌন্দর্য, মর্যাদা ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের পরও তা অন্যান্য প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট নয়। কোনো বাস্তববাদী মানুষ এটা দাবি করবে না যে আমাদের পাঠক্রমগুলোতে জীবনের প্রয়োজনীয় সব কিছু আছে। মাদরাসার পাঠক্রমও এই দাবি করে না। তবে সিলেবাস বা পাঠক্রম মানুষের ভেতর সেই যোগ্যতা তৈরি করে দেয়, যা মানুষকে প্রতিটি পদক্ষেপে পথ দেখায় এবং তার ভেতর নেতৃত্বের গুণাবলি সৃষ্টি করে।
পাঠক্রম শিক্ষার্থীর ভেতর এতটুকু যোগ্যতা তৈরি করে যে সে বই-পুস্তক পড়ে উপকৃত হতে পারে। তা জীবনের সব প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণের অঙ্গীকার করে না। প্রাচীন পাঠক্রমও কখনো এই দাবি করেনি।
আধুনিক যুগের শিক্ষাবিদদের সামনে একটি প্রশ্ন জোরালোভাবে উত্থাপিত হচ্ছে যে পাঠক্রম ছাড়া আর এমন কী কী বিষয় শিক্ষার্থীদের সামনে পেশ করা হবে, যা তাদের জীবন, মর্যাদা ও সম্মানের দাবিগুলো পূরণ করবে? আর যে পরিবেশে এসব চাহিদা পূরণ হয়, তা শিক্ষার্থীদের জন্য কিভাবে নিশ্চিত করতে হবে? বিষয়টি পশ্চিমা বিশ্বের শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে প্রাচ্যের আলেমসমাজ পর্যন্ত সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এর সমাধানের একটি দিক এটা হতে পারে যে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠাগার প্রস্তুত করা হবে। এরপর একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বইগুলো অধ্যয়নে নির্দেশনা দেবেন, যেন শিক্ষার্থীরা জীবনের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না হয়। যখন তারা এসব বই যথাযথভাবে অধ্যয়ন করবে, তখন তাদের কাছে জীবনযাত্রা অপরিচিত মনে হবে না। আরেকটি পদ্ধতি এমন হতে পারে যে শিক্ষার্থীদের জন্য ধীরে ধীরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পারদর্শী ব্যক্তিদের প্রস্তুত করা হবে, যাঁরা তাদের সামনে নতুন পরিবেশ ও বাস্তবতা তুলে ধরবেন এবং তাঁরা জ্ঞানের প্রাচীন ধারাগুলোর পরিবর্তে নতুন ধারাগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পরিতৃপ্ত করবেন।
এই পদ্ধতি আমাদের দেশেও প্রয়োগ করা হচ্ছে। যেমন—আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ও জামিয়া মিল্লিয়াতে। মধ্যপ্রাচ্যের শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতেও এই পদ্ধতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দর ও প্রশংসনীয় যে বিভিন্ন শাস্ত্রের অভিজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা এখানে এসে তাঁদের লেখনী ও বক্তব্যের মাধ্যমে তাঁদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সার-নির্যাস শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরবেন। শিক্ষার্থীরাও জ্ঞানের বৈঠক ও সমাগমস্থলে উপস্থিত হবে।
কেননা জ্ঞানীদের সঙ্গে সংযোগ তৈরি হলেই জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়। এ কথা তারা সহজেই অনুভব করতে পারবে যারা আল্লামা শিবলি নোমানি (রহ.) ও সাইয়েদ সুলাইমান নদভি (রহ.)-এর বৈঠকগুলোতে অংশগ্রহণ করেছিল। মাওলানা সাইয়েদ সুলাইমান নদভি (রহ.) আল্লামা শিবলি নোমানি (রহ.)-এর বৈঠকে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন এবং তাঁর জ্ঞানের সরোবরে অবগাহন করতেন। ফলে তাঁর ভেতর এমন অনুভব, অনুভূতি, রুচি-অভিরুচি, চিন্তা-চেতনা ও যোগ্যতা তৈরি হয়, যা খুব কম মানুষের ভেতরই তৈরি হয়ে থাকে।
আমাদের জন্য (মাদরাসা শিক্ষার্থীদের) এটা অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় যে আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই গতিশীল যুগেও বিজ্ঞান ও পৃথিবীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানটুকুও রাখি না, বরং তা জানার আগ্রহও আমাদের নেই, যা এই যুগে চলার জন্য অপরিহার্য। আমি বলব, এতটুকু জ্ঞান সংবাদপত্র ও পত্রপত্রিকার ভাষা বুঝতেও প্রয়োজন হয়। এ জন্যও আমাদের প্রয়োজন এই বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তিদের কাছে যাওয়া এবং তাঁদের বৈঠকে অংশ নেওয়া। কোনো বিষয়ে রুচি তৈরি হয়ে যাওয়ার অর্থটি এমন যে আপনার সামনে কেউ কোনো কবিতা পাঠ করলে আপনি আপনার সাহিত্যের অভিরুচি থেকে বলে দেবেন এটা অমুক কবির কবিতা। এমন যেন না হয় যে আপনার সামনে আনিস ও দাবিরের কবিতা পাঠ করা হলো আর আপনি গালিব বা জওকের বলে মনে করলেন। এই অভিরুচি তৈরি হয় জ্ঞানীদের দীর্ঘ সংস্রব এবং তাঁদের বৈঠকে নিয়মিত উপস্থিত হলে।
এমনকি মানুষ যখন জ্ঞানের স্তরে পিছিয়ে থাকে এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রাথমিক ও মৌলিক বিষয়গুলোও না জানে, তবু জ্ঞানীদের বৈঠকে অংশগ্রহণ তার জন্য উপকারী হয়। যখন আমি যুবক ছিলাম এবং আমি তখনো ‘নুজহাতুল খাওয়াতির’ বইয়ে ভারতের বরেণ্য মনীষীদের জীবনী পাঠ করিনি, তখন একবার মাওলানা সুলাইমান আশরাফ (রহ.)-এর বৈঠকে অংশগ্রহণ করলাম। বৈঠকে মুফতি ইউসুফ (রহ.)-এর আলোচনা এলো। আলোচনাটি আমার কাছে অস্পষ্ট থেকে গেল। আমি বলে উঠলাম, মুফতি সাহেব মাওলানা আবদুল হাই (রহ.)-এর জামাতা ছিলেন। মাওলানা সুলাইমান আশরাফ (রহ.) সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘মৌলভি সাহেব! চুপ থাকেন।’ বিষয়টি আমার খুব খারাপ লাগল। কিন্তু আমি এই শিক্ষা পেলাম যে হতে পারে মুফতি ইউসুফ দ্বারা অন্য কোনো ব্যক্তি উদ্দেশ্য।
আমার সৌভাগ্য যে আমি আলেমদের এমন কিছু বৈঠকে উপস্থিত হয়েছি যেখানে শুধু জ্ঞানের আলোচনা হতো। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেখানে জ্ঞানমূলক কথাই হতো। মাওলানা সাইয়েদ সুলাইমান নদভি (রহ.)-এর বৈঠক, শাহ হালিম আতা (রহ.)-এর বৈঠক, আল্লামা ইকবালের বৈঠকগুলো এমন ছিল। যদিও আমি আল্লামা ইকবালের বৈঠকে মাত্র দুইবার অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমি মনে করি, মাদরাসাগুলোতে ইতিহাস ও ইসলামী জ্ঞানের নানা শাখায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের যেভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তেমনি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরও আমন্ত্রণ জানানো প্রয়োজন। যাঁরা রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, মহাকাশবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে আলোচনা করবেন। একইভাবে কবিতা ও সাহিত্যে পারদর্শীদেরও আমন্ত্রণ জানাতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের ভেতর রুচি ও অভিরুচি তৈরি হবে।
মনে রাখতে হবে, অভিরুচি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহও বটে। দ্বিনি জ্ঞানের অভিরুচি আল্লাহ পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী, সত্যান্বেষী ও পরিশ্রমী ব্যক্তিকে দান করেন। প্রদীপ থেকে প্রদীপ প্রজ্বালিত হয়, তবে যে প্রদীপ প্রজ্বলিত হতে চায় তার ভেতরও প্রজ্বালনের যোগ্যতা থাকতে হবে। এই যোগ্যতা তৈরি হয় তিনটি মৌলিক গুণের বদৌলতে। তা হলো ইতেকাদ তথা সুধারণা ও বিশ্বাস, ইতেমাদ তথা আস্থা ও নির্ভরতা এবং ইত্তেহাদ তথা অভিন্ন চিন্তা-চেতনার অধিকারী হওয়া। আবার এসব গুণ তৈরি হবে গুরুজন ও শিক্ষকের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও যোগাযোগের ভিত্তিতে, যা বর্তমান যুগে বিরলপ্রজ।