আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে জীবননগরের মৃৎশিল্প 

প্রকাশকালঃ ১০ অক্টোবর ২০২৪ ০৩:৫৯ অপরাহ্ণ ৪৮৯ বার পঠিত
আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে জীবননগরের মৃৎশিল্প 

ঢাকা প্রেস
মো:সবুজ হোসেন, চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধিঃ-

 

কালের বিবর্তনে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার দেহাটি ও মনোহরপুর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মৃৎ শিল্প। বহুমুখী সমস্যা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আজ সংকটের মুখে পড়েছে এই মৃৎশিল্পটি। তারপরও পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য এখনও ধরে রেখেছে অনেকেই। বাঙালি জীবনের হাজার বছরের ঐতিহ্য বহনকারী মাটির তৈরি সামগ্রীর চাহিদা কমতে থাকায় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন শিল্পটি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। 

 

আধুনিক জিনিসপত্রের ভিড়, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকা এবং মাটি সংগ্রহের দাম বৃদ্ধিসহ নানা সংকট এ শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে বলে জানান কুমারেরা। মৃৎশিল্প বাঙালির শত বছরের পুরনো ঐতিহ্য। কিন্তু কালের বিবর্তনে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে এই শিল্পের প্রসার। 

 

বিজ্ঞানের জয়যাত্রা, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও নতুন নতুন শিল্পসামগ্রীর প্রসারের কারণে এবং প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও অনুকূল বাজারের অভাবে এ শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে।  অনেকে এ পেশায় থাকলেও মাটির তৈরি সামগ্রীর চাহিদা না থাকায় অভাব-অনটনে সংসার চালাতে পারছেন না তারা।

 

সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো জীবননগর উপজেলার দেহাটি ও মনোহরপুর গ্রামে বসবাসকারী মৃৎশিল্পীদের অধিকাংশই পাল সম্প্রদায়ের। প্রাচীন কাল থেকে ধর্মীয় এবং আর্থ সামাজিক কারণে মৃৎশিল্পে শ্রেণিভুক্ত সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

 

বর্তমান বাজারে এখন আর আগের মতো মাটির জিনিস পত্রের চাহিদা না থাকায় এর স্থান দখল করে নিয়েছে দস্তা, অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের বস্তু। ফলে বিক্রেতারা মাটির জিনিসপত্র আগের মতো আগ্রহের সঙ্গে নিচ্ছে না। তাদের চাহিদা নির্ভর করে ক্রেতাদের ওপর। কিন্তু উপজেলার বিভিন্ন বাজারে এখন আর মাটির হাড়ি-পাতিল ক্রয়বিক্রয় তেমনটা চোখে পড়ে না।

 

সে কারণে অনেক পুরোনো শিল্পীরাও পেশা ছেড়ে পুর্বপুরুষদের দেশ ভারতে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মাটির জিনিসপত্র তার পুরোনো ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। 

 

ফলে এ পেশায় যারা জড়িত এবং যাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন মৃৎশিল্প তাদের জীবন যাপন একেবারেই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। দুঃখ কষ্টের মাঝে দিন কাটলেও জীবননগরের মৃৎশিল্পীরা এখনও স্বপ্ন দেখেন। কোন একদিন আবারও কদর বাড়বে মাটির পণ্যের। সেদিন হয়তো আবারো তাদের পরিবারে ফিরে আসবে সুখ-শান্তি। আর সেই সুদিনের অপেক্ষায় আজও দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তারা।

 

এ বিষয়ে উপজেলার দেহাটি পালপাড়া গ্রামের সুনীল কুমার পাল বলেন, বাপ-দাদার কাছে শেখা আমাদের এই জাত ব্যবসা আজও আমরা ধরে রেখেছি। দেহাটিসহ জীবননগর উপজেলার আশপাশের এলাকায় একসময় মাটির তৈরি জিনিসের ব্যাপক চাহিদা ছিল, কিন্তু বর্তমানে বহুমুখী সমস্যা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আজ সংকটের মুখে পড়েছে এই মৃৎশিল্পটি। অনেক মৃৎশিল্প আছে পরিবারের অভাব অনাটন মেটানোর জন্য এ শিল্প ছেড়ে কৃষিকাজ সহ বিভিন্ন ব্যাবসার কাজে নিয়জিত হয়ে পড়েছে।

 

বিকাশ কুমার পাল জানান, একসময় তাঁদের গ্রামের পাশের বিভিন্ন জমি থেকে বিনা মূল্যে মাটি সংগ্রহ করতে পারতেন। কিন্তু এখন এলাকায় ইটের ভাটা বেড়ে যাওয়ার কারণে কৃষকেরা আর বিনা মূল্যে তাঁদের মাটি দিচ্ছেন না। ইটের ভাটায় মাটি বিক্রি করে দিচ্ছেন তাঁরা। এ জন্য মাটি কিনে এসব জিনিসপত্র তৈরি করে আগের মতো লাভ হয় না বলে জানান তিনি।

 

মনোহরপুর পালপাড়ার মৃৎশিল্পী উত্তম কুমার পাল জানান, একসময় বিভিন্ন ধরনের হাঁড়ি–পাতিল সহ বাচ্চাদের খেলনা মিলিয়ে ৪০-৫০ প্রকার জিনিস তৈরি করা হতো। কিন্তু এখন মাত্র ৮-১০ প্রকার জিনিস তৈরি হচ্ছে। কেবল শীত মৌসুমে এলে খেজুর রসের ভাড়ের (কলস) চাহিদা বেশি থাকায়  তৈরির চাপ বাড়ে। এ ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়ে কাজের তেমন চাপ থাকে না।

 

দেহাটি সমাজ কল্যান তরুণ সংঘের সভাপতি মো. শামীম হোসেন জানান, মাটির জিনিসের চাহিদা কমতে থাকায় এবং মাটি সংগ্রহে খরচ বেশি হয় বলে মৃৎশিল্পীরা দিন দিন এ ঐতিহ্য থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে। তবে কিছু সংখ্যক পরিবার বংশ পরম্পরার কারণে এ শিল্প ধরে রেখেছে। এ শিল্পের জন্য সরকারিভাবে যদি কোনো সহযোগিতা করা হয় তবে বাঙালির ঐতিহ্যময় এ শিল্প ধরে রাখতে পারবে মৃৎশিল্পীরা।

 

এদিকে উপজেলার সচেতন মহল ও বিশিষ্টজনরা মনে করছেন মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এর বাজার সৃষ্টি এবং প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা খুবই জরুরি।