কাইয়ুম চৌধুরী,বিশেষ প্রতিনিধি:-
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলীয় এলাকা অবস্হিত জাহাজভাঙা শিল্পে শ্রমিক অধিকার ও পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে হংকং আন্তর্জাতিক কনভেনশনের বাস্তবায়ন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বিলস্ কর্তৃক আয়োজিত এক সেমিনারে এমন আশংকা প্রকাশ করেছেন শ্রমিক নেতৃবৃন্দ ও সেমিনারে অংশগ্রহনকারী অন্যান্য অংশীজন।
২০২৩ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশ হংকং কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করে, যা বাস্তবায়নের জন্য মাত্র দুই বছর সময় নির্ধারিত। সেই সময়সীমার শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে জাহাজভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের উদ্যোগে আজ সীতাকুণ্ডের ইপসা এইচআরডি সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় এক মতবিনিময়মূলক সেমিনার।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ফোরামের আহ্বায়ক বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা তপন দত্ত এবং সঞ্চালনায় ছিলেন সদস্য সচিব ও বিলস-ওশ সেন্টারের কো-অর্ডিনেটর ফজলুল কবির মিন্টু।
প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সীতাকুণ্ড উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ফখরুল ইসলাম। বিশেষ বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এ এম নাজিম উদ্দিন, সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা লুৎফুন্নেসা বেগম, ইন্ডাস্ট্রিইয়াল পুলিশের পরিদর্শক নাহিদুল ইসলাম, সীতাকুণ্ড প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফোরকান আবু, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল কাইয়ুম চৌধুরী, সাবেক সভাপতি সৌমিত্র চক্রবর্তী, জাহাজভাঙা শ্রমিক সেফটি কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক দিদারুল আলম চৌধুরী।বক্তব্য রাখেন, জাহাজভাঙা শ্রমিক সেফটি কমিটির সদস্য মাহাবুব চৌধুরী, বিএমএফ এর যুগ্ম সম্পাদক মোঃ আলী, বিএমএসএফ এর যুগ্ম সম্পাদক মোঃ ইদ্রিছ, টিইউসির সংগঠক জামাল উদ্দিন প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, বিশ্বের ৯২% জাহাজভাঙা কার্যক্রম বাংলাদেশসহ চারটি দেশে সংঘটিত হয়, যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। প্রতি বছর ২০-২৫ লাখ টন রি-রোলেবল স্ক্র্যাপ সংগ্রহ করে দেশের ইস্পাত চাহিদার প্রায় ৬০% পূরণ করা হলেও শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা উপেক্ষিত।
তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে সীতাকুণ্ডে ১৬টি দুর্ঘটনায় একজন শ্রমিক নিহত ও ১৭ জন আহত হয়েছেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণে গড়িমসি করছে। এস এন কর্পোরেশন দুর্ঘটনার পর তিন মাস বন্ধ ছিল, কিন্তু শ্রমিকদের কেউ মজুরি পায়নি, কেউ চাকরি হারিয়েছে।
বক্তারা বলেন, এখনো জাহাজে বিষাক্ত অ্যাসবেস্টস পাওয়া যাচ্ছে, যা শ্রমিকদের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলছে। বিএসবিএ হাসপাতালে শ্রমিকেরা পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাচ্ছেন না। কাজের প্রকৃত ঝুঁকি ও বাস্তবতা সম্পর্কে না জেনেই শ্রমিকরা কাজে যোগ দেন। নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র ও ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত না হওয়ায় শ্রমিকরা জিম্মি হয়ে পড়ছেন।
পরিবেশদূষণ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করে বক্তারা জানান, উপকূলীয় অঞ্চলে সিসা, ক্রোমিয়ামসহ ক্ষতিকর পদার্থ জমা হচ্ছে; গাছ টিকছে না, মানুষ কিভাবে টিকবে—এ প্রশ্ন ওঠে।
সেমিনারে বক্তারা দাবি জানান—
• সরকার-মালিক যৌথভাবে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে
• কর রাজস্বের ৫% শ্রমিক ও স্থানীয় মানুষের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে
• কোরবান ঈদে শ্রমিকদের বোনাস প্রদান নিশ্চিত করতে হবে
• সীতাকুণ্ডে জাহাজভাঙা শ্রমিকদের জন্য আলাদা প্রশাসনিক দপ্তর খুলতে হবে
• দীর্ঘসময় চাকরি শেষে চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে
• ঠিকাদারের অজুহাতে মালিক যেন দায় এড়াতে না পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফখরুল ইসলাম বলেন, “জাতীয় উন্নয়ন তখনই টেকসই হবে, যখন শ্রমজীবী মানুষদের অগ্রসর করার মাধ্যমে তাদের জীবন-মান উন্নয়ন করা যাবে।” সেমিনারের উপসংহারে তপন দত্ত বলেন, “জাহাজভাঙা শিল্পের পরিবেশবান্ধব ও শ্রমিকবান্ধব রূপান্তর কেবল আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা নয়—এটি দেশের মানুষের স্বাস্থ্য, উপকূলের ভবিষ্যৎ এবং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন।