নিজস্ব প্রতিবেদক:
গণপূর্ত অধিদপ্তরকে ঘিরে ধারাবাহিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ যখন বিভিন্ন গণমাধ্যম ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে আসছে, ঠিক সেই সময় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘প্রতিবাদ’-এর ব্যানারে একটি মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টদের দাবি, এ কর্মসূচি গণপূর্তের ভাবমূর্তি রক্ষার আন্দোলন নয়; বরং প্রভাবশালী প্রকৌশলীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা একটি কথিত ঠিকাদার সিন্ডিকেটের আত্মরক্ষামূলক শক্তি প্রদর্শন।
বুধবার সকালে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনটি ঘিরে সাধারণ ঠিকাদার ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিস্ময় ও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। তাঁদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন ধরে যাঁরা অবৈধ সুবিধা ভোগ করেছেন, তাঁরাই এখন ‘অসত্য অভিযোগ’-এর অভিযোগ তুলে রাজপথে নেমেছেন।
মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীরা দাবি করেন, বাংলাদেশ ঠিকাদার সমিতির নাম ব্যবহার করে কিছু ব্যক্তি গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ ছড়াচ্ছে। তাঁদের মতে, অভিযোগকারীরা প্রকৃত ঠিকাদার নন এবং অসৎ উদ্দেশ্যেই এসব করছেন।
তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, মানববন্ধনে উপস্থিত অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রভাবশালী নির্বাহী ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। অভিযোগ রয়েছে—এই বলয়টি ঠিকাদারি কাজ ভাগাভাগি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, বিল ছাড় ও প্রকল্প বণ্টনে দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব বিস্তার করে আসছে।
এতে প্রশ্ন উঠেছে—এই মানববন্ধন কি সত্যিই গণপূর্তের স্বার্থে, নাকি নিজেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সাধারণ ঠিকাদার বলেন, “নিয়ম মেনে কাজ করতে গেলে আমরা সুযোগ পাই না। নির্দিষ্ট কিছু লোক সব কাজ বাগিয়ে নেয়। আজ তারাই আবার প্রেসক্লাবে দাঁড়িয়ে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করছে—এটা হাস্যকর।”
গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও বলছেন, প্রকৃত অনিয়মের তদন্তের বদলে যারা প্রশ্ন তুলছেন, তাঁদের দমন করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
মানববন্ধনে গণপূর্ত ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রফিক হাওলাদার বলেন, “গণপূর্ত ঠিকাদার সমিতি সারাদেশব্যাপী একটি সংগঠিত প্রতিষ্ঠান। আমাদের নেতৃত্বে রয়েছেন তালিকাভুক্ত প্রথম শ্রেণির ঠিকাদাররা। যারা অভিযোগ তুলছে, তারা কেউই ঠিকাদার নয়।”
তিনি আরও বলেন, “ভবিষ্যতে মানববন্ধনের নামে বিভ্রান্তি ছড়ালে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে অনুরোধ—তাদের পরিচয় যাচাই করবেন। প্রয়োজনে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।” তবে সমালোচকদের প্রশ্ন—সবকিছু স্বচ্ছ হলে নিরপেক্ষ তদন্তে আপত্তি কেন?
মানববন্ধনে বক্তব্য দেন গণপূর্ত ঠিকাদার সমিতির সহ-সভাপতি আবু রায়হান, সিটি ডিভিশনের ঠিকাদার সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান খোকন, ঢাকা গণপূর্ত বিভাগের ২ নম্বর ডিভিশনের সভাপতি আশরাফসহ আরও কয়েকজন নেতা। তবে উপস্থিত অনেকের পরিচয় নিয়েই ধোঁয়াশা রয়েছে বলে দাবি সাধারণ ঠিকাদারদের।
সংশ্লিষ্ট মহলের প্রশ্ন, গণপূর্ত অধিদপ্তরকে ঘিরে ওঠা অভিযোগ যদি সত্যিই ভিত্তিহীন হয়, তবে তার জবাব মানববন্ধনে নয়, নিরপেক্ষ তদন্তে আসা উচিত। কেন বারবার একই গোষ্ঠী কাজ পায়, কেন অভিযোগ তুললেই ‘ভুয়া ঠিকাদার’ তকমা দেওয়া হয়—এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো অনুপস্থিত।
এই প্রেক্ষাপটে, জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনকে অনেকেই দেখছেন সিন্ডিকেট রক্ষার একটি নাটকীয় প্রদর্শনী হিসেবে। চলমান অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের এই প্রেক্ষাপটে শেষ পর্যন্ত জবাবদিহির মুখোমুখি কারা হবেন—সেদিকেই এখন নজর সংশ্লিষ্টদের।