নরসিংদী প্রতিনিধি:
‘এত ভয়ংকর সময় জীবনে দেখিনি। ঝাঁকুনিতে ঘরের দেয়াল ফেটে গেছে। বাইরে বের হতে গিয়ে স্বামী গুরুতর আহত হয়েছে। এখনো মনে পড়লে শরীর কেঁপে ওঠে।’—গতকাল শুক্রবার সকালে সংঘটিত ভূমিকম্পের ভয়াবহতার বর্ণনা দিতে গিয়ে এসব কথা বলেন নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ওয়াপদা গেট এলাকার গৃহবধূ সামসুন নাহার মলি। ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল এই অঞ্চলেই।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানায়, কেন্দ্রস্থল নরসিংদীর মাধবদী অঞ্চল। যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী, কেন্দ্রস্থল নরসিংদী সদরের প্রায় ১৪ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণ পশ্চিমে। গুগল ম্যাপ অনুযায়ী, সুনির্দিষ্ট স্থানটি পলাশ উপজেলার ডাংগা গ্রাম, যা শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ঘোড়াশাল পৌর এলাকার কাছাকাছি।
দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, পলাশ রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের প্রধান ফটকের সামনের সড়কে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। পাশের একটি গরুর খামারের মাটিও ফেটে গেছে। আশপাশের অনেক ভবনে ফাটল দেখা গেছে, কিছু বহুতল ভবন হেলে পড়েছে। ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং আগুনও লাগে। শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর পুরোনো রেলসেতুতে ফাটল দেখা গেছে। এ ঘটনায় দুজনের মৃত্যু এবং অন্তত ২০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
ডাংগা–কালীগঞ্জ খেয়াঘাটের মাঝি সুবাদ ভৌমিক বলেন, ‘ভূমিকম্পের সময় নদীর পানি অনেক ওপরে উঠে প্রচণ্ড ঢেউ তৈরি করে। ভয় পেয়ে যাই। জীবনে এমন কম্পন প্রথমবার অনুভব করলাম।’
ইসলামপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী ফয়সাল জানান, ‘প্রথমে মনে হয়েছিল ভারী কোনো লরি যাচ্ছে। পরে দেখি পুরো কারখানা কাঁপছে। শ্রমিকরা মুহূর্তেই বাইরে চলে আসেন। বড় ক্ষয়ক্ষতি না হলেও কয়েকজন ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।’
পাশের দোকানদার ফজলু মিয়া বলেন, ‘হঠাৎ বিকট শব্দে সবকিছু কাঁপতে থাকে। কিছু সময় পর দেখি কলেজগেটের ভেতর মাটিতে ফাটল তৈরি হয়েছে। জীবনে এমন দৃশ্য দেখিনি।’
নূর নবী সানির স্ত্রী তামান্না বলেন, ‘কেমন সময় ছিল, তা বলে বোঝানো যাবে না। বাচ্চাদের নিয়ে নিচে নামার সুযোগও পাইনি। শুধু আল্লাহকে ডাকছিলাম। ঘরের ফ্রিজ, টিভি ও আসবাব ভেঙে যায়।’
শিশুদের আতঙ্ক
প্লে-শ্রেণির শিক্ষার্থী মুনতাসির আয়াত বলে, ‘ভয়ে কেঁদে ফেলি। ঘরের বই-খাতা সব নিচে পড়ে যায়। মা–বাবা আমাকে নিয়ে দৌড়ে বাইরে বের হয়।’
শিশু আয়ান জানায়, ‘এখনও ভয় লাগে—যদি আবার এমন হয়।’
বাজার ও ভবনে ব্যাপক ক্ষতি
ঘোড়াশাল বাজারে দোকানের তাক থেকে মালপত্র পড়ে গেছে। জুতা ব্যবসায়ী আলম মিয়া বলেন, ‘ভূমিকম্প শুরু হতেই জুতা ও আসবাবপত্র ভেঙে পড়ে যায়।’
মুদি দোকানি আসলাম মিয়ার দোকানের সব কাচের সামগ্রী ভেঙে গেছে। তিনি বলেন, ‘প্রথমে হামলা ভেবেছিলাম, পরে বুঝি ভূমিকম্প।’
মারকাসুল সুন্নাহ তাহফিজুল কোরআন মাদ্রাসার পরিচালক মুফতি সালাউদ্দিন আনসারী জানান, ভবনের চার–পাঁচ জায়গায় ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
ভবনের মালিক আমানউল্লাহ বলেন, ‘ফাটল দেখা দিয়েছে বিভিন্ন স্থানে। ভয়ে কেউ দোকান খুলছে না।’
গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত এসএ প্লাজার মোবাইল ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন বলেন, ‘হঠাৎ মনে হলো সব ভেঙে পড়ছে। সবাই দৌড়ে বাইরে যাই। ওপরতলা থেকে নিচে নামার সময় অনেকেই সিঁড়িতে পড়ে যায়। কান্নার শব্দ চারদিকে।’
আল জিলানী মার্কেটের তিনতলার রেলিং ভেঙে পাশের দোকানের ওপর পড়ে। দোকানি তাজুল ইসলাম বলেন, ‘পুরো দেয়ালটা দোকানের ওপর পড়ে তছনছ হয়ে যায়। কীভাবে বেঁচে গেলাম, আল্লাহই জানেন।’
আরটিভির জেলা প্রতিনিধি নূরে আলম রনি জানান, তিনি বাইরে বের হওয়ার সময় সিঁড়িতে পড়ে মুখে আঘাত পান। পরে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
প্রশাসনের পদক্ষেপ
পলাশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু বক্কর সিদ্দিকী জানান, ভূমিকম্পের পর বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সার কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে। সরকারি খাদ্যগুদামে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, দ্রুত চাল সরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়কে ইতিমধ্যে জানানো হয়েছে।
ভয়াবহ এ ভূমিকম্পের স্মৃতি এখনও তাজা—জেলা জুড়ে বিরাজ করছে আতঙ্ক, ক্ষয়ক্ষতির সঠিক হিসাব চলছে।